জাপানে বার্ড ফ্লু: খাবার মেনু থেকে বাদ পড়ছে ডিম


ইউএনভি ডেস্ক:

ডিমের বদলে মাছের অমলেট, অভিনব লাগছে না?‘এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা’ বা বার্ড ফ্লুর সবথেকে মারাত্মক প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে লড়াই করা জাপানে এখন অনেককে খাবারের মেনুতে এই বদলই আনতে হচ্ছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিবিসি।

প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় লাখ লাখ মুরগি মেরে ফেলতে হচ্ছে, ফলশ্রুতিতে ডিমে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, ডিমের তৈরি খাবারের দামও বাড়ছে। এক কথায়, জাপানে এখন ডিম বিলাসবহুল হয়ে উঠেছে।

এটা একই সঙ্গে জাপানি খাবারেও বিরাট সমস্যা ডেকে এনেছে; রোল থেকে শুরু করে ওমুরিস কিংবা নুডুলসে হালকা সিদ্ধ কুসুম, দেশটির এমন অনেক খাবারে ডিমই ছিল প্রধান উপকরণ। সেসব খাবারের মেনুতে করা লাগছে ব্যাপক রদবদল।

এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা মূলত পোল্ট্রি ও বন্য পাখির একটি সংক্রামক রোগ যা সাধারণত বার্ড ফ্লু নামেই বেশি পরিচিত; প্রায় এক শতাব্দী ধরে পোল্ট্রি খাতে এই রোগের দেখা মিলছে।

বিজ্ঞানিরা বলছেন, সম্ভবত ভাইরাসের মিউটেশনের কারণে বিশ্ব এখন বার্ড ফ্লুর সবচেয়ে খারাপ প্রাদুর্ভাবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। জাপানে এটি কঠোরভাবে আঘাত হেনেছে। ১ কোটি ৭০ লাখ মুরগি নিধন করা হয়েছে, অর্থ্যাৎ ডিম পাড়া মুরগির ৯ শতাংশ মেরে ফেলা হয়েছে।

এর প্রভাবে ডিমের পাইকারি দাম গত বছরের তুলনায় ৭০ শতাংশ বেড়ে গেছে, স্থানীয় এক বিক্রেতা এমনটাই জানিয়েছেন।

মাঝারি আকারের এক কেজি ডিমের দাম এখন প্রায় ৩৫০ ইয়েন (২.৬২ ডলার), বলছে ন্যাশনাল ফেডারেশন অব এগ্রিকালচারাল কোঅপারেটিভ অ্যাসোসিয়েশনের ইউনিট জেডএ জেড-টামাগো। ভোক্তাদের জন্য দামের এই ধাক্কা বেশি না হলেও দামবৃদ্ধি ও ডিমের ঘাটতিজনিত প্রবণতায় অনেক খাবারের মেনু থেকে এখন ডিম বাদ পড়ছে।

<div class=”paragraphs”><p>টোকিওর ম্যাকডোনাল্ড’স রেস্তোরাঁ। ছবি: রয়টার্স</p></div>
টোকিওর ম্যাকডোনাল্ড’স রেস্তোরাঁ। ছবি: রয়টার্স
গত মাসে ম্যাকডোনাল্ডস গ্রাহকদের সতর্ক করে বলেছিল, তারা পিক পিরিয়ডে তাদের জনপ্রিয় টেরিটামা বার্গারের বিক্রি স্থগিত রাখতে পারে। টেরিয়াকি সস ও টামাগো দিয়ে এই টেরিটামা বানানো হয়। জাপানি ভাষায় টামাগোর অর্থই হচ্ছে ডিম।

ম্যাকডোনাল্ডসের মুখপাত্র জোনাথন কুশনার বিবিসিকে জানান, রেস্তোরাঁর নিয়মিত খাদ্য সরবরাহে যেন ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্য ম্যাকডোনাল্ডস বিভিন্ন উৎস থেকে ডিম সংগ্রহ করতে পারলেও সংকটজনিত পরিস্থিতির ওপর তারা সতর্ক নজর রাখছে।

“মূল বিষয়টি হল, দেশে সরবরাহ অস্থিতিশীল। গ্রীষ্ম আর শরতে পরিস্থিতি কেমন হবে, তা অনুমান করা কঠিন”, বলেন তিনি।

জাপানের ‘সেভেন-ইলেভেন’ দোকানগুলোকে ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫টি পণ্যের বিক্রি স্থগিত রাখতে হয়েছে। এর পাশাপাশি দেশজুড়েই খাবারের দোকানগুলোতে স্যান্ডউইচ ও সালাদের রেসিপিতে আনতে হয়েছে পরিবর্তন।

ক্রেতাদেরও আগের চেয়ে বেশি পয়সা গুণতে হচ্ছে। ডিমের কুসুম থেকে তৈরি স্বতন্ত্র এক স্বাদের মেয়োনিজের কারণে পরিচিত ফুড কোম্পানি ‘কিউপি’ চলতি মাস থেকে তাদের পণ্যের দাম ২১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। এই দামবৃদ্ধির পরও কোম্পানিটির লাভ এই অর্থবছরে ৪৭ শতাংশ কম হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ফুড মেনুতে কাটছাঁট করতে বাধ্য হয়েছে। খাবার বিক্রির চেইনশপ স্কাইলার্ক হোল্ডিং ফেব্রুয়ারি থেকে ডিম দিয়ে ফ্রাইড রাইস ও প্যানকেকের মতো অনেক মেনুর বিক্রি স্থগিত করেছে।

আগে গরম পাত্রে দেওয়া সুকিয়াকির সঙ্গে জাপানি-স্টাইলের ডিম পোচ গ্রাহকদের ফ্রিতে দেওয়া হলেও এখন সেটির জন্য ৫৫ ইয়েন নেওয়া হচ্ছে।

<div class=”paragraphs”><p>জাপানের জনপ্রিয় টেরিটামা বার্গার।</p></div>
জাপানের জনপ্রিয় টেরিটামা বার্গার।
গবেষণা সংস্থা টেইকোকু ডেটাব্যাংক ১০০টি রেস্তোরাঁর ওপর জরিপ চালিয়ে দেখেছে, জাপানে তালিকাভুক্ত ২৮ শতাংশ রেস্তোরাঁ তাদের খাবারের তালিকায় কাটাছাঁট করেছে বা কিছু কিছু আইটেম স্থগিতের কথা ভাবছে।

বার্ড ফ্লুর কারণে যে বিপুল সংখ্যক মুরগি মারা হয়েছে, তাতে নিকট ভবিষ্যতেও ডিমের সরবরাহ স্বাভাবিক হবে না বলেই মনে করছে সংস্থাটি। এ কারণে দামের চাপও বলবৎ থাকবে, বলছেন খাদ্য নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা।

গবেষণা সংস্থা নরিনচুকিনের নির্বাহী ফেলো কাতসুহিকো কিতাহারা বলেছেন, বার্ড ফ্লুর প্রকোপ কমার কোনো লক্ষণ না থাকায় উৎপাদন পুরোপুরি আগের অবস্থায় ফিরবে বলেও আশা যাচ্ছে না।

“পোল্ট্রি ফিডের অতিরিক্ত দামের কারণে কিছু খামার বন্ধ হয়ে যাবে বলেই আশঙ্কা করছি,” বলেছেন তিনি।

ফলে রেস্তোরাঁ আর বাবুর্চিদের এখন বিকল্প পথ খুঁজতে হচ্ছে। যেমন, সীফুড জায়ান্ট নিসুই করপোরেশন জাপানের টামাগোয়াকি (রোলড ওমলেট) বানিয়েছে আলাস্কার পোলাক মাছ থেকে। ডিমে যাদের এলার্জি আছে, তাদের চাহিদার কথা চিন্তা করে ২০২২ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই ওই খাবারটি নিসুইয়ের তাকে ছিল।

কখনোই এই খাবার ‘ব্যাপক বিক্রি হত না’, বলেছেন নিসুইয়ের মুখপাত্র তেতসুয়া আইদা।

অথচ এ বছর এই খাবারটির চাহিদা সুপারমার্কেটে পাঁচগুণ বেড়ে গেছে।

“এই মুহূর্তে আমাদের অস্বাভাবিক রকমের বিক্রি চলছে,” তবে বেচা-বিক্রির সঠিক পরিমাণ প্রকাশ করতে চাননি তিনি।

স্থানীয় ফুড কোম্পানিগুলোকে ফুড মেনুতে ডিম সরিয়ে এমনই বিকল্প খুঁজতে হচ্ছে। জাপানের ‘টু-ফুডস’ কোম্পানি জানায়, গত মাসে ডিমের পরিবর্তে তারা গাজর ও ক্যানিলিনি বিন বা এক প্রকারের মটরশুটির মত সবজি থেকে জনপ্রিয় ওমুরিস তৈরি করেছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘এভার এগ’।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এই ‘এভার এগ’ নিয়ে খুচরা বিক্রেতা ও রেস্তোরাঁগুলোর জিজ্ঞাসা বেড়ে গেলেও ‘টু-ফুডস’ এ বিষয়ে বিস্তারিক বলতে চায়নি।


শর্টলিংকঃ