জামদানির নকশার একাল–সেকাল


চলতে-ফিরতে ডেস্ক:
জামদানির শাড়ির (Jamdani Saree) নকশার কথা বললেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে শাড়ির পাড়ভর্তি রঙিন ফুল আর জ্যামিতিক ছাঁচ; জমিনের টানা ও পোড়েনের সুতায় রঙিন বুটি আর ছিডার জাল বা তেরছি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো জামদানির নকশার ইতিহাসে এই ‘রঙিন নকশা’ মাত্র শখানেক বছরের গল্প।

যেহেতু গবেষকেরা মনে করেন, জামদানি হচ্ছে মসলিনের ‘অপভ্রংশ’ রূপ, আর মসলিন ছিল টানাপোড়েনে সাদা সুতায় তৈরি। তাই ধারণা করা যায়, জামদানির আদি নকশা সাদা সুতার ওপরে সাদা সুতা দিয়ে করা হতো। তবে খুব অল্প পরিমাণ রঙিন সুতা যে ব্যবহৃত হতো না, সেটা বলা যায় না।

জামদানি বস্ত্রের নকশার এই বিবর্তনের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে হাকিম হাবিবুর রহমানের (১৮৮১-১৯৪৭) নাম উল্লেখ করা যায়। তিনি বলছেন, ‘আমাদের বাল্যকাল পর্যন্ত জামদানির উত্তম ধরনসমূহের মধ্যে “আশরাফি বুটি”, “মাছিবুটি”, “জালিদার এবং লহরিয়া” নামের সাদা রঙের জামদানি তৈরি হতো এবং এটিই হচ্ছে প্রাচীন ধারা।’ অবশ্য হাকিম হাবিবুর রহমান এও বলছেন, শাড়ির পাড়ে কালো ও লাল বুটির প্রচলন তাঁর বাল্যকালেই শুরু হয়।

১৯৪৫ সালে তিনি বলছেন,‘আজ থেকে ৫০ বছর আগে পর্যন্ত জামদানি শুধু সাদাই তৈরি হতো, অবশ্য শাড়ির হাসিয়ায় লাল–কালো (সুতার) কাজ সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হতো, জমিন সাদা থাকত এবং এটাই ছিল আসল রীতি। আমার বাল্যকালে…ওই সময় পর্যন্ত শুধু সাদা জমিনের জামদানি তৈরি হতো।’ জামদানির নকশার বিবর্তনের একই রকম তথ্য দিয়েছেন জর্জ ওয়াট ও পার্সি ব্রাউন।

এরপর জামদানির নকশা আরও পরিবর্তনের পথে হাঁটতে শুরু করে। হাকিম হাবিবুর রহমানের মতে, এই পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ (১৮৭১-১৯১৫)। হাকিম সাহেব জানাচ্ছেন, ‘…সর্বপ্রথম তিনি বিভিন্ন ধরনের রঙের জমিনের ওপর ভিন্ন ভিন্ন রঙের বুটি ও ফুল নিজস্ব ডিজাইন এবং নকশা সহযোগে তৈরি করান এবং সর্বপ্রথম তিনিই রঙিন জামদানির ব্যবহার শুরু করেন। ফুলের মধ্যে বড় বড় উদ্ভাবন হতে থাকে এবং জীবনের শেষের দিকে দৈনন্দিন সময়ের এক বড় অংশ তাঁর এ ধরনের নকশা তৈরিতেই কেটে যেত।

এই জামদানি অবশ্যই খুব দামি হয়ে গিয়েছিল। বাংলার ধনী ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এটিই ব্যবহার করা শুরু করেন এবং সাদা জামদানির ব্যবহার প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।’ অর্থাৎ মানে দাঁড়াচ্ছে, উনিশ শতকের শেষ দশকে কিংবা বিশ শতকের শুরুর দিকে নবাব স্যার সলিমুল্লাহর পৃষ্ঠপোষকতায় রঙিন জামদানি তৈরি হওয়া শুরু হয় এবং ক্রমে তা জনপ্রিয় হতেও শুরু করে। জীবনসায়হ্নে এসে নবাবের নিজে নকশাকার হয়ে যাওয়ার তথ্যটি আমাদের কাছে চিত্তাকর্ষকই বটে!

হাকিম হাবিবুর রহমানের সূত্র অনুযায়ী, জামদানি বস্ত্রের রঙিন নকশার গল্প শুরু হয় নবাব স্যার সলিমুল্লাহর সময় থেকে। তত দিনে জামদানিতে রঙিন নকশার যুগ শুরু হয়েছে। ফুল, পাখি, লতাপাতা—সবই রঙিন।

জামদানি সম্পর্কে ১০ তথ্য
১. একসময় নারীদের জামদানি কাপড় বুনতে দেওয়া হতো না। মনে করা হতো, মেয়েদের জামদানি বয়ন করা শেখালে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে তাঁরা জামদানি বুনতে শুরু করবেন। এতে ব্যবসা বেহাত হয়ে যাবে।
২. জামদানি কাপড় বোনার জন্য হাতে সুতা তৈরি করা হতো। স্থানীয় পদ্ধতিতে তৈরি সরল তাঁতযন্ত্রে এখনো হাতেই বোনা হয় জামদানি। জামদানি কাপড় তৈরির জন্য যে তাঁত ব্যবহার করা হয়, তার স্থানীয় নাম ‘পডি’।
৩. জামদানিতে নকশা তোলার জন্য মহিষের শিং দিয়ে তৈরি কাণ্ডুল ব্যবহার করা হয়; যদিও এখন প্লাস্টিকের কাণ্ডুল বাজারে পাওয়া যায়।
৪. জামদানি শাড়ির পাড়ের নকশার নামে শাড়ির নামকরণ করা হয়।
৫. জামদানি বস্ত্র বোনার জন্য যে তুলার চাষ হতো, সেই তুলার বীজ এখন আর পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয়, উনিশ শতকে তুলার সেই স্থানীয় প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়।
৬. জামদানি বস্ত্র তৈরি করার জন্য একটি তাঁতে দুজন তাঁতি বসে কাজ করেন। ডান পাশে যিনি বসেন, তিনি ওস্তাদ কারিগর। বাঁ পাশে যিনি বসেন, তিনি শাগরেদ।
৭. খুব ছোটবেলা থেকে জামদানি–তাঁতিদের বস্ত্র বয়ন করতে শেখানো হয়। ধারণা করা হয়, ছোটবেলায় মানুষের হাত খুব নরম থাকে বলে তারা ভালো নকশা করতে পারে।
৮. শীতলক্ষ্যা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র—এই তিন নদ-নদীর মধ্যবর্তী যে বিস্তীর্ণ অঞ্চল, সেখানে জামদানি বস্ত্র তৈরির তুলা উৎপন্ন হতো। এই তুলা দিয়ে মসলিন বস্ত্রও তৈরি করা হতো।
৯. হাফসিল্ক ও ফুলকটন—এই দুই ধরনের জামদানি তৈরি হয়। টানায় সিল্ক সুতা এবং পোড়েনে সুতি সুতা দিয়ে হাফসিল্ক এবং টানা-পোড়েনে সুতির সুতা দিয়ে ফুলকটন জামদানি তৈরি হয়।
১০. বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ ও সোনারগাঁ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে জামদানি তৈরি হয়। এর বাইরে ভৈরবের কয়েকটি গ্রামে এবং ফরিদপুরের কয়েকটি গ্রামে জামদানি শাড়ি তৈরি হয়। ‘টাঙ্গাইলা জামদানি’ নামে বাজারে যে শাড়ি বিক্রি হয়, সেগুলো জামদানি শাড়ি নয়। সেগুলোতে শুধু জামদানির নকশা তোলা হয়। কিন্তু শাড়িগুলো তৈরি হয় চিত্তরঞ্জন তাঁতে।

 


শর্টলিংকঃ