‘দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়’ নীতি হাজী সেলিমের


ইউএনভি ডেস্ক:

ব্যক্তিস্বার্থের কারণে বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে এসেছিলেন হাজী মোহাম্মদ সেলিম। নৌকার দলীয় মনোনয়ন পেয়ে হয়েছিলেন সংসদ সদস্য। আবার আওয়ামী লীগ মনোনয়ন না দিলে হয়ে যান বিদ্রোহী। দলের প্রার্থীর বিপক্ষে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হয়ে গঠন করেন স্বতন্ত্র জোট। পরে নানামুখী তদবিরে আবার জায়গা দখল করে নেন ক্ষমতাসীন দলে। দল ক্ষমা করলে মনোনয়ন বাগিয়ে আবারও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু দলের প্রতি অনুগত ছিলেন না কখনোই। সব সময় ‘দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়’-এমন নীতিতেই অটল ছিলেন হাজী সেলিম।


হাজী সেলিম সম্পর্কে এমন মন্তব্য করেছেন ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা এবং পুরান ঢাকার স্থানীয়রা। কিন্তু হাজী সেলিম ও তার ছেলে ইরফান এতটাই প্রভাবশালী যে, ভয়ে কেউ নাম প্রকাশ করে মন্তব্য করতে রাজি হননি। কারণ তাদের ক্যাডাররা এখনও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে সেলিমের ছেলে ঢাকা দক্ষিণ সিটির বহিষ্কৃত কাউন্সিলর ইরফান কারাগারে ঢোকার পর অনেকে নেতাকর্মী ও স্থানীয়রা মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তবে শর্ত একটি-পরিচয় গোপন রাখতে হবে। তাদের শঙ্কা-কিছুদিন পর হয়তো সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আবার শুরু হবে পুরান ঢাকায় সেলিম পরিবারের রাজত্ব।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের একাধিক নেতা বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, হাজী সেলিম দলের সিদ্ধান্ত পক্ষে না গেলেই করেছেন বিদ্রোহ। নিজের ছেলেকেও সেই পথেই হাঁটা শেখাচ্ছিলেন পুরান ঢাকার আলোচিত-সমালোচিত এই সংসদ সদস্য। কাউন্সিলর পদে ছেলে দলের সমর্থন পেতে ব্যর্থ হলে তাকেও বিদ্রোহী প্রার্থী করে দলের প্রার্থীর বিপক্ষে নির্বাচন করিয়েছিলেন।

অতীত কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজী সেলিমের নাম। অন্যায়-অনিয়মের পথ ধরেই তার উত্থান বলেও অভিযোগ রয়েছে। আর সে কারণে তিনি সব সময় বেছে নিয়েছেন ক্ষমতার রাজনীতি। থাকতে চেয়েছেন ক্ষমতায়। এ কাজে যখন-যেভাবে প্রয়োজন, রাজনীতি ও দলকে শুধু হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারই করেছেন। প্রয়োজনে পরিবর্তন করেছেন দল, গেছেন দলের সিদ্ধান্তের বাইরে। আসলে তার কাছে দল নয়, সব সময় নিজের স্বার্থই ছিল বড় কথা।

সম্প্রতি ছেলে ইরফান সেলিমের ঘটনা দিয়ে আলোচনায় এলেও মূলত পাহাড়সম অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই এবার কপাল পুড়তে যাচ্ছে হাজী সেলিমের। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই অভিযোগ করছেন- হাজী সেলিম সব সময়ই ছিলেন সুবিধাবাদী। তিনি রাজনীতি ও জনপ্রতিনিধির ক্ষমতা ব্যবহার করে আধিপত্য বিস্তার করেন। ক্ষমতার পাশাপাশি আইনের জাল থেকে বের হতেও তিনি ব্যবহার করেছেন রাজনীতিকে। তাই ১৯৯৬ সালে বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে এলেও দলের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারেননি হাজী সেলিম। নিজের স্বার্থে আঘাত লাগলেই বদলিয়েছেন রং।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের এক সদস্য বলেন, এই ধরনের নেতারা আসলে কোনো দলেরই নন। তারা যখন যেখানে সুযোগ-সুবিধা পান, অপকর্ম ও অন্যায় ঢাকতে সেখানেই আশ্রয় নেন। এদের বিষয়ে আমাদের দলের নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা খুবই কঠোর। দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি সবার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিচ্ছেন। ফলে অন্যায়-অপকর্ম করে এখন আর দলের শেল্টার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দল, সরকার ও জাতীয় সংসদ-সবারই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, সংসদ সদস্যরা আইনপ্রণেতা। তারাই যদি আইন ভঙ্গকারী হন, তাহলে তো আইনের শাসন হল না। এ বিষয়গুলোয় দল, সরকার ও জাতীয় সংসদ-সবারই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। তবে দুঃখজনক হল-কেউ তদের ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করছে না।

মূলত নব্বইয়ের দশকের শুরুতে রাজনীতিতে সক্রিয় হন হাজী মোহাম্মদ সেলিম। বিএনপি নেতা মীর শওকত আলী ও নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুর হাত ধরেই উত্থান। ১৯৯৪ সালে তিনি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ৬৫ ও ৬৬ নম্বর ওয়ার্ডে গরুর গাড়ি মার্কা নিয়ে কমিশনার নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময়ে একটি ওয়ার্ড ছেড়ে দিলে তার স্ত্রী গুলশান আরা সেলিম ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে সরাসরি ভোটে সর্বপ্রথম মহিলা কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।

১৯৯৬ সালে তৎকালীন অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কমিশনার হাজী সেলিম জাতীয় নির্বাচনে সংসদ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নিজ দল বিএনপি তাকে মনোনয়ন না দেয়ায়, দল ছেড়ে যোগ দেন আওয়ামী লীগে।

সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ঢাকায় আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকেন তিনি। এরই মধ্যে পুরান ঢাকার রাজনীতিতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন তিনি। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অবৈধ দখলসহ নানা অভিযোগ উঠতে থাকে তার বিরুদ্ধে। ২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের বাইরে চলে গিয়েছিলেন তিনি।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলেও মামলার কারণে নির্বাচন কমিশন তাকে অযোগ্য ঘোষণা করেন। ২০০৮ সালের ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। দল ক্ষমতায় আসার শুরুর দিকে তার প্রভাব কিছুটা কম ছিল। সেসময় সাংগঠনিক কাজে সক্রিয় থাকেন তিনি। আজিজ-মায়া কমিটিতে তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এ সময় মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের সঙ্গে নানা বিষয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন হাজী সেলিম। দলীয় সংসদ সদস্যের বিপক্ষে গিয়ে তৈরি করেন আলাদা ব্লক।

নিজের অবস্থান জানান দিতেই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আবার দলের মনোনয়ন নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন হাজী সেলিম। কিন্তু এবারও দলের সিদ্ধান্ত যায় মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের পক্ষে। তখনই দলের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে চলে যান হাজী সেলিম। হন বিদ্রোহী প্রার্থী। নৌকার বিপক্ষে নির্বাচন করে মহিউদ্দিনকে পরাজিত করে নির্বাচিত হন, যা বিএনপিবিহীন ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিব্রত করে। তবে বিএনপি অংশ না নেয়ায় ওই নির্বাচনের পরে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় রক্ষা পান হাজী সেলিম।

তবে শুধু দলের বিপক্ষে নির্বাচন করেই ক্ষান্ত দেননি হাজী সেলিম। সেই সময়ে ‘স্বতন্ত্র এমপি জোট’ নামে স্বতন্ত্র এমপিদের দিয়ে তিনি একটি জোটও গঠন করেন। এরপর তিনি হারান ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদটি। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য থাকার সময় সরকার ও আওয়ামী লীগের সমালোচনায় মুখর থাকতেন হাজী সেলিম। সংসদে নানা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বিতর্কের জন্ম দিতেন হাজী সেলিম।

বিশেষ করে সংসদে ছাত্রলীগকে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে তুলনা করে বক্তব্য দিয়েছিলেন। ২০১৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদ অধিবেশনে অনির্ধারিত আলোচনায় হাজী সেলিম বলেছিলেন, ‘শিবির রগ কাটে; ছাত্রলীগ কবজি কাটে, মাথা কাটে। টিভি-পত্রিকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক আছে বললে চলবে না। কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নইলে মানুষ আমাদের সঙ্গে থাকবে না।’ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ওই বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতিও দিয়েছিল।

শুধু সংসদ নির্বাচন নয়, যখনই দলের সিদ্ধান্ত তার বিপেক্ষ গেছে, তখনই তা অমান্য করেছেন হাজী সেলিম। ২০১৫ সালে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দক্ষিণের মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সংসদে পদত্যাগপত্রও জমা দেন যথাসময়ে। হাইকমান্ডের চাপে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করলেও সেই সময়ে দলের প্রার্থী সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন বলে অভিযোগ ছিল। সাঈদ খোকন যে হাজী সেলিমের কর্মকাণ্ডে গোস্সা, তা নির্বাচনের পরের দিনই বোঝা যায়। ২৯ এপ্রিল নির্বাচন-উত্তর এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সবার নাম ধরে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করলেও উপস্থিত হাজী সেলিমের নাম এড়িয়ে যান সাঈদ খোকন। এরপরই অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন হাজী সেলিম।

২০১৬ সালের মাঝামাঝি স্ট্রোকের কারণে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন তিনি। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আবারও আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন বাগিয়ে নেন। এই সময় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলেন হাজী সেলিম। এদিকে নির্বাচনে বিজয়ের পর আবার আগের মতোই ক্ষমতা প্রদর্শনের অভিযোগ আসতে থাকে তার বিরুদ্ধে। সর্বশেষ ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে সেলিমপুত্র ইরফান সেলিম ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেলে সেখানেও ছেলেকে বিদ্রোহী প্রার্থী বানিয়ে নির্বাচন করিয়েছেন। এমপির প্রভাব খাটিয়ে দলের প্রার্থীকে হারিয়ে ছেলেকে বিজয়ী করেন।

এদিকে নিজের অধিপত্য ধরে রাখতে শুধু দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্যই নয়, দলীয় নেতা বা জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে খারাপ আচরণের অভিযোগও আছে হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে রাজধানীর লালবাগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি আয়োজিত অনুষ্ঠানে ব্যানারে নিজের নাম আর ছবি না থাকায় ক্ষিপ্ত হয়ে স্থানীয় কাউন্সিলরকে পেটান ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিম। এ সময় অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে মাইক ও বিভিন্ন সরঞ্জাম ফেলে দেন তার কর্মীরা।


শর্টলিংকঃ