দুস্থ-এতিমের দুম্বার মাংস ধনীর রান্নাঘরে


ইউএনভি ডেস্ক:

লাথি পড়ে গরিবের পেটেই– প্রবাদটি আরেকবার নির্ভুল হলো। সৌদি আরব সরকারের পাঠানো দুম্বার মাংসের বড় অংশই যায়নি দরিদ্র কিংবা দুস্থের কুঁড়েঘরে। ছলে-বলে-কৌশলে কেড়ে নেওয়া সেই মাংস বিত্তবানের রান্নাঘরের হাঁড়িতেই চড়েছে। শুধু তাই নয়, বিত্তশালীর কেউ কেউ দুম্বার মাংস রান্নার আয়োজন ও ভূরিভোজের ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছেন।

কোরবানির ঈদের পর দরিদ্র ও দুস্থদের জন্য বাংলাদেশে দুম্বার মাংস পাঠানো সৌদি সরকারের প্রতিবছরের রেওয়াজ। এবারও ১৩ হাজার ৬৮০ কার্টনে ৩ লাখ ৭২ হাজার কেজি (৩৭২ টন) দুম্বার মাংস দেশে আসে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিচালক (ত্রাণ) মো. রাসেল সাবরিনের গত ১৪ জানুয়ারি সই করা এক চিঠিতে বলা হয়েছে, সৌদি আরব থেকে আসা দুম্বার মাংস দুস্থ ও অসহায় মানুষের মধ্যে বিতরণের জন্য জেলা প্রশাসকদের কাছে পাঠানো হয়েছে। সেই মাংস চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ফ্রিজিং ভ্যানে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স সাম সিন্ডিকেট প্রাইভেট লিমিটেড’ ৬৩ জেলার ইউনিয়ন পর্যায়ে ধাপে ধাপে পৌঁছে দেয়। দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলছে বিতরণ কার্যক্রম।

তালিকা করে দুম্বার মাংস দুস্থ, এতিমখানা ও মাদ্রাসায় বিতরণের কথা থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা ঘরে নিয়ে গেছেন।

অভিযোগ পেয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তালিকা ধরে ১০ জেলায় অনুসন্ধান চালায় সমকাল। এর মধ্যে অধিকাংশ জেলাতেই মিলেছে ছলচাতুরী ও অনিয়মের তথ্য। কোথাও সরকারি কর্মকর্তা মাংসে ভাগ বসিয়েছেন, আবার কেউ আপনজনকে দিয়েছেন মাংস উপহার! কোনো কোনো জনপ্রতিনিধির পেটেও গেছে দুম্বার মাংস। গেল দুই সপ্তাহে দুম্বার মাংস হাঁড়িতে চড়ার অর্ধশত ভিডিও ফেসবুক ও ইউটিউবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসব ভিডিওতে অধিকাংশ ব্যক্তিই বলছেন, সৌদি থেকে পাঠানো মাংস তাদের কেউ না কেউ উপহার দিয়েছেন।

খোদ রাজধানীতেই দুম্বার মাংস বিক্রির তথ্য মিলেছে। ফেসবুকে ভিডিও দিয়ে এক ব্যক্তি বলেছেন, রাজধানীর ধানমন্ডিতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের এক কর্মী বেশ কিছু দুম্বার মাংস বিক্রি করেছেন। সেখান থেকে তিনি কিনেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি জানান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার সুবাদে অনেক বিত্তশালী মাংস পেয়েছেন। আবার অধিদপ্তরের কিছু কর্মচারী মাংস বাইরে বিক্রিও করেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, গরিবের জন্য পাঠানো মাংস বিতরণে অনিয়মের ঘটনা দুঃখজনক। এই মাংসের সম্পূর্ণ অধিকার দুস্থ, অভাবগ্রস্ত ও এতিমদের। তবে তাতে প্রভাবশালীদের ভাগ বসানো লজ্জাজনক। তিনি বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর থেকে মাংস বরাদ্দ দেওয়া হলেও মাঠ পর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তার হাতে নিয়ন্ত্রণ থাকে না। জনপ্রতিনিধিকে দায়িত্ব দেওয়ার কারণে অনিয়ম হচ্ছে বলে দাবি তাঁর।

এক টুকরা গোশতের অপেক্ষায়
তিস্তা ও যমুনা নদীর দুর্গম পোড়ারচর। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের কাপাসিয়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড। নানা দুর্যোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে এ চরে প্রায় ১ হাজার ২০০ মানুষের বাস। পোড়ারচরে কথা হয় হাফিজার রহমানের সঙ্গে। বারুদ কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘এক টুকরা দুম্বার গোশতও পাই নাই। হামার কপালে দুম্বার গোশত জোটে নাই কোনো দিন।’ সমকালের কাছে একই অনুযোগ চরের বাসিন্দা মফিজ, কেরামত আলী, লাল মিয়া, মজিদ মিয়া ও বিশা শেখের। তারা বলেন, শুনেছি দুম্বার মাংস এসেছে গরিব মানুষের জন্য। তবে আমাদের ভাগ্যে এক টুকরাও জুটল না। গরিব মানুষের মাংস কোথায় যায়, তা জানতে চাই? বৃদ্ধ ময়ফুল বেওয়া বলেন, ‘মেম্বর কয় গোস্ত হামরায় পাই নাই। আর তোক দেই কোটে থাকি?’

গ্রামে গ্রামে অনিয়মের ভূত!
সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ও ৯ ইউপি চেয়ারম্যানকে বরাদ্দ দেওয়া হয় ২৪ কার্টন (৪৮০ কেজি) দুম্বার মাংস। তবে এসব মাংসের কোনো হদিস পাননি খোদ ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যরা। দোহালিয়া ইউপি সদস্য শফিকুর রহমান, জিয়াউল ইসলাম, আবদুল করিম, সুলতান আহমদ, মোহন মালা ও মিরা রানী নাথ পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, কোথাও মাংস বিতরণ করতে দেখিনি। এভাবে প্রতিবছর আসা দুম্বার মাংস কার পেটে যায়, তা জানি না।

গত ১১ জানুয়ারি ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে ১৪ কার্টন মাংস পাওয়ার পর পাঁচ ইউপি চেয়ারম্যানকে এক কার্টন করে পাঁচ কার্টন ও পৌর মেয়রকে এক কার্টন মাংস দেওয়া হয়। বাকি আট কার্টন পৌরসভার ছয়টিসহ ইউনিয়নের ১৬টি এতিমখানার শিক্ষার্থীদের জন্য দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, প্রতি কার্টনে ১০ পিস করে দুম্বার মাংস ছিল। তবে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার দপ্তর থেকে প্রতি কার্টনে সর্বোচ্চ চার টুকরা করে ছিল বলে জানানো হয়। সে হিসাবে ১৬ মাদ্রাসা ও এতিমখানায় দুই পিস করে মাংস দেওয়া হয়। বাকি মাংস বিতরণকারীরাই ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছে। এলাঙ্গী ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান জানান, অল্প পরিমাণ মাংস পাওয়ায় বাইরের কাউকে না দিয়ে সব ইউপি সদস্য, চৌকিদার, সচিব ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।

খুলনার রূপসায় ১৪ কার্টন দুম্বার মাংস যায় গেল ২৩ জানুয়ারি। প্রতি কার্টনে ১০ পিস করে দুম্বার মাংস ছিল। এসব মাংস এতিম ও দুস্থদের মধ্যে বরাদ্দ দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা ঠিকভাবে বিতরণ করা হয়নি। উপজেলায় শতাধিক মাদ্রাসা থাকলেও এর মধ্যে মাত্র ২৮ প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ পিস করে দুম্বার মাংস দেওয়া হয়েছে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ে বিতরণের তালিকায় উপজেলা মডেল মসজিদের নাম থাকলেও বিষয়টি ওই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলদের কেউ জানেনই না। মডেল মসজিদের নামে দুম্বার মাংস কাকে দেওয়া হয়েছে বা কে নিয়েছে, তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। এ ব্যাপারে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান বলেন, দ্রুত সময়ে বণ্টন করা হয়েছে। কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে পরবর্তী বছর যাচাই-বাছাই করে ঠিকভাবে দেওয়া হবে।

ময়মনসিংহে প্রায় ২০০ মণ দুম্বার মাংস সরকারি কর্মচারী, ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা অফিস জানায়, কয়েক দিন আগে সন্ধ্যায় ৪০০ কার্টন দুম্বার মাংস জেলার ১৩ উপজেলার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ আসে। পরে ওই দিনই তা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট এলাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ মাংস দুস্থদের মধ্যে বিতরণ না করায় প্রতিবাদ জানিয়েছেন গৌরীপুরের পৌর মেয়র সৈয়দ মো. রফিকুল ইসলাম। নিজের ফেসবুকের দেয়ালে তিনি লেখেন, ‘উপজেলা পরিষদে গরিব দুস্থদের জন্য আসা দুম্বার মাংস মুহূর্তেই হাওয়া। দুম্বার মাংস সুষ্ঠুভাবে বিতরণ না করে নেতাদের দিয়ে দেওয়া হয়েছে। গরিবের হক নষ্ট করার তীব্র প্রতিবাদ জানাই।’

জামালপুরের মেলান্দহে ৩০ কার্টন মাংস বরাদ্দ ছিল। গত ১৬ জানুয়ারি গোপনে দুম্বার মাংস উপজেলার কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও জনপ্রতিনিধির মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে দুই কার্টন, জামিয়া হুসাইনিয়া আরবিয়া পুরুষ ও মহিলা মাদ্রাসায় দুই কার্টন, ১১টি ইউনিয়নে ১১ কার্টন, মেলান্দহ ও হাজরাবাড়ী পৌরসভায় দুই কার্টন করে বিতরণ করা হয়।

উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, ১৭ কার্টন বিতরণের তথ্য থাকলেও বাদবাকি ১৩ কার্টন কোথায় বিতরণ করা হয়েছে, এর কোনো তথ্য নেই। জামালপুর সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) সভাপতি অজয় কুমার পাল বলেন, দুস্থদের জন্য আসা মাংস বিতরণে অনিয়ম নিন্দনীয় কাজ। আমরা চাই, এটি সঠিকভাবে অসহায় মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হোক।

যশোরের মনিরামপুরে মাংসে ভাগ বসিয়েছেন উপজেলার শীর্ষস্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। তবে এ নিয়ে কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাই মুখ খুলছেন না। অবশ্য উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার দপ্তরের সহকারী গোলাম সরোয়ার বলেন, ৪৫ কার্টন দুম্বার মাংস এসেছে। ইউএনও আমাকে বণ্টনের দায়িত্ব দিয়েছেন। নতুন এমপি এস এম ইয়াকুব আলীকে ১৬ কার্টন, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নাজমা খানমকে দুই কার্টন, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানকে এক কার্টন, ১৭ ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের ১৭ কার্টন ও ১২ এতিমখানায় ১২ কার্টন মাংস দেওয়া হয়েছে। সাংবাদিকদের জন্য এক কার্টন মাংস রাখা হয়েছে। বিতরণের সময় উপজেলায় কিছু গরিব লোক এসেছেন। তাদেরও দেওয়া হয়েছে। এদিকে উপজেলার ১২ এতিমখানার প্রতিটিতে এক কার্টন করে মাংস দেওয়ার কথা বলা হলেও তাদের তিন থেকে চার প্যাকেট করে বিতরণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে মনিরামপুর আসনের সংসদ সদস্য এস এম ইয়াকুব আলী বলেন, ‘আমাকে এমপি হিসেবে ১৫ কার্টন দিয়েছে। আমার একজন প্রতিনিধির মাধ্যমে ১৫টি ইউনিয়নে মাংস পাঠিয়ে দিয়েছি। যাদের দিয়েছি, তারা যদি দু-চারজনকে দিয়ে বাকিটা নিজেরা খেয়ে ফেলে, সে বিষয়ে কিছু করার থাকে না। কারণ, বাড়ি বাড়ি গিয়ে তো আমার খোঁজ নেওয়া সম্ভব নয়।’

নয়ছয়ের প্রমাণ ভিডিওচিত্রে
হবিগঞ্জের বানিয়াচং, বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলার দুম্বার মাংসের কার্টন খুলে কমবেশি করা হয়েছে। মাংসের কার্টন খুলে সেখান থেকে দু-এক প্যাকেট সরিয়ে ফের প্যাকেট করতে দেখা যায় বিতরণকারীদের। এ রকম প্যাকেট খোলা ও মাংস নিয়ে যাওয়ার কয়েকটি ভিডিওচিত্র এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

অধিদপ্তর-মন্ত্রণালয় কী বলছে
এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, অসহায় মানুষের কাছে এ মাংস পৌঁছানোর দায়িত্ব ইউএনওর। মাংস যেন শুধু গরিবরা পান, সে নির্দেশনা জেলা প্রশাসক ও ইউএনওকে দেওয়া থাকে। যেহেতু এটি কোরবানির মাংস, তাই এ পবিত্র মাংসের প্রতি অনেক মানুষের আকাঙ্ক্ষা থাকে। তবে চাইলেও সবাইকে দেওয়া যায় না। ভবিষ্যতে যাতে আরও ভালোভাবে বিতরণ করা যায়, সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, জেলা পর্যায় থেকে বিতরণের তথ্য এখনও আমাদের হাতে আসেনি। তবে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ ব্যাপারে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান বলেন, গত বছর দুম্বার মাংস বিতরণে দেরি হয়েছিল। এবার যথাসময়ে পৌঁছে দিয়েছি। আসলে এ মাংস শুধু দুস্থ, এতিম ও অসহায় মানুষের জন্য। আমরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিকে অন্তর্ভুক্ত করে বিতরণের জন্য মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়ে থাকি। সুবিধাভোগীদের তালিকাও জনপ্রতিনিধিদের সহায়তা নিয়ে করা হয়। এখন যদি কেউ এ কাজে কোনো অপরাধ করে, তাহলে আমরা ব্যবস্থা নেব। আমরা দেখব, এ ধরনের অপকর্মে কারা জড়িত এবং কীভাবে জড়িত। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না।

 


শর্টলিংকঃ