নওয়াব ফয়জুন্নেছার রূপজালাল


গ্রন্থ প্রকাশ

ফয়জন্নেছার রূপজালাল প্রকাশিত হয় আজ থেকে শতবর্ষেরও পূর্বে। তখন ঢাকা থেকে মাত্র কিছুকাল আগে ‘নীলদর্পণ’ প্রকাশিত হয় ‘বাঙ্গালা যন্ত্র’ বা প্রেস থেকে। এই সময় ঢাকা থেকে ঢাকা প্রকাশ, বান্ধব পত্রিকা প্রকাশ হতে শুরু হয়েছে।

ফয়জন্নেছার গ্রন্থ এ-পরিবেশে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। সাহিত্য প্রকাশনায় ঢাকার মর্যাদা বৃদ্ধি করে ‘রূপজালাল’ প্রকাশের ঘটনাটিও ঐতিহাসিক হয়ে উঠে। উল্লেখ্য, ঢাকার সাথে তাঁর সংযোগটি আকস্মিক নয় বলেই মনে হয়; ‘ঢাকা প্রকাশ’ (৫ মাঘ ১২৮১)-এ তাঁর ঢাকায় অবস্থানের সংবাদটি আমরা আগে লক্ষ করেছি (তৃতীয় অধ্যায় ২য়-উপ অধ্যায় দ্রষ্টব্য)। বলা বাহুল্য, এ-সময়ই তিনি (নারী) শিক্ষা বিস্তারকল্পেও যথেষ্ট কীর্তি স্থাপন দ্বারা গৌরব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

গ্রন্থখানির ‘আভ্যন্তরীণ আখ্যা পত্র’ (এবং ‘অনুক্রমণিকা’) থেকে অন্যান্য তথ্য অর্থাৎ, প্রকাশকাল, প্রকাশ-যন্ত্র ও প্রকাশক, মূল্য (এবং উৎসাহদাতা) ইত্যাদি সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়।

এখানে উল্লেখ্য, এই বছরই পরের দিকে রাস সুন্দরী দাসীর ‘আমার জীবন’ এবং বিরাজ মোহিনী দাসীর ‘কবিতার হার’ আত্মপ্রকাশ করে। তত্পূর্বে মাত্র কয়েকজন স্বল্প পরিচিতা লেখিকার কথা জানা যায়, যথা—কৃষ্ণকুমারী দাসী (চিত্তবিলাসিনী, ১৮৫৬), কৈলাসবাসিনী দেবী (বিশ্বশোভা, ১৮৬৯), অন্নদা সুন্দরী দেবী (অবলা বিলাস ১৮৭২) এবং ইন্দুমতি দাসী (দুঃখ মালা, ১৮৭৪)। কয়েকজন অজ্ঞাতনামা লেখিকার কথাও কেউ কেউ বলেছেন। এ-ছাড়া সংবাদ প্রভাকর, বামাবোধিনী প্রভৃতি পত্রিকায়ও লেখিকাদের রচনাদি প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এ-সমস্তই উল্লেখ-সার নাম, সাহিত্যে তাঁদের রচনার কোনো ফল লক্ষ করা যায় না। তাদের অন্য পরিচয়ও ইতিহাসে নেই।

মুসলমান লেখিকাদেরও একাধিক নাম জানা গেছে। একজন পদ্মাবতী কাব্যের লিপিকার রহিমুন্নিছা, অপরজন ‘বামাবোধিনীর’ পত্র লেখিকা তাহিরউন্নিসা। কিন্তু ফয়জন্নেছার মতো তাঁদের রচনা মুদ্রিত হয়নি বা গ্রন্থবদ্ধ প্রকাশরূপ নেয়নি। মোবাশ্বের আলী যথার্থই বলেন (১৩৮৭: ১০৯ পৃষ্ঠা):

‘ফয়জন্নেছা শুধু লিখেই ক্ষান্ত হননি, তাঁর বক্তব্য পাঠক সাধারণের মধ্যে ব্যাপক প্রচারণার জন্যে মুদ্রাযন্ত্রের সহায়তা নিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে তিনিই প্রথম মুসলমান মহিলা সাহিত্যিক, যিনি মুদ্রাযন্ত্রের সাহায্য গ্রহণ করেছেন।

১৮৭৬ সালের ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখে ‘রূপজালাল’ প্রকাশিত হয়।

রূপজালাল-গ্রন্থ পরিচিতি ও বৈশিষ্ট্য

‘রূপজালাল’ গ্রন্থের প্রথম পরিচিতি পাওয়া যায় ১২৮৩ সনের বান্ধব পত্রিকার একটি বিজ্ঞাপনে (পরিশিষ্টে সংযোজিত); তাতে অন্য বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ ছাড়াও যোগ করা হয়েছিল যে, এটি একটি ‘গদ্যপদ্যময় অভিনব কাব্য’। এ প্রসঙ্গে সমালোচকগণের মন্তব্য লক্ষ করা যেতে পারে। মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের মতে এটি ‘আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস’, তবে এতে কবি তাঁর ‘অন্তর্দাহ প্রকাশ করতে গিয়ে মাঝে মাঝে কবিতারও আশ্রয় নিয়েছেন।’ মনসুরউদ্দীন, মজিরউদ্দীন প্রভৃতিতেও এর সমর্থন, এমনকি একই রকম বক্তব্য দেখি। আবদুল আউয়াল (১৯৭৫: ৪৫ পৃষ্ঠা) মন্তব্য করেন, একে ‘গদ্যপদ্য মিশ্রিত উপাখ্যান বলাই শ্রেয়ঃ’।

আবার ‘রূপজালাল’ একটি পৃথক সাহিত্য-রীতির কাব্য এ কথাও অনেকে বলেন। ‘রূপজালাল’ প্রকাশনার শতবার্ষিকী সভায় (সেমিনারে) মোবাশ্বের আলী এই দিক থেকে গ্রন্থটির মূল্য ও অন্তর্গত দৃষ্টিভঙ্গিটি বিচারের চেষ্টা করেন, পরে আবু তালিবে তার সমর্থন দেখা যায়। মোবাশ্বের আলীর (১৩৮৭: ১০৯ পৃষ্ঠা) বক্তব ছিল:

‘সাহিত্যিকরূপে তার অভিনবত্ব এখানে যে “রূপজালাল” আঙ্গিকের দিক দিয়ে একটি ব্যতিক্রমধর্মী গ্রন্থ এবং বাংলা সাহিত্যে এরূপ গ্রন্থ বিরল দৃষ্ট। এটি গদ্যেপদ্যে বিরচিত—যাকে সংস্কৃতে চম্পু কাব্য বলা হয়। তিনি সংস্কৃত থেকেই সাহিত্যকর্মের এই রূপটি গ্রহণ করেন। চম্পু কাব্যে গদ্য বা পদ্য কতটুকু তা সুনির্দিষ্ট নন। তবে গদ্যাংশের সাথে পদ্যাংশের বিষয়বস্তু অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।’

তিনি বৈদিক সাহিত্যে লভ্য চম্পু কাব্য এবং পরে বৌদ্ধ ও জৈনসাহিত্যের, বিশেষত Oldenberg আবিষ্কৃত আর্যসূরী জাতকমালায় চম্পু কাব্যগুলির প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন এবং সংস্কৃত সাহিত্যের সাথে ফয়জন্নেছার ‘নিবিড় পরিচর’-এর ইঙ্গিত করেন। মধ্যযুগাবধি মুসলমান কবিদের সংস্কৃতে অধিকার, আলাওল-সম তার পাণ্ডিত্ব ও বিদ্যাসাগরের মতো সংস্কৃত বুনট সমৃদ্ধ গদ্যভাষার উল্লেখ দ্বারাও তাঁর ঐ মতের সমর্থন খোঁজেন তিনি। শুধু তাই নয়, এ-প্রসঙ্গে বিভিন্ন পুরাণ ব্যবহারের প্রসঙ্গেও তিনি আসেন।

গ্রন্থখানি খুবই পরিকল্পিত। এবং সর্বত্র কবি ছন্দে, অলঙ্কার প্রয়োগে এবং সাধারণ বর্ণনায় খুবই পরিশীলিত ও পরিমিত। এটাও তাঁর আঙ্গিক সচেতনতার পরিচয়। পৌরাণিক ও লৌকিক কাহিনীর ব্যবহার, উপমাদিতে হিন্দু-মুসলমান উভয় পুরাণ-প্রসঙ্গে অবাধ বিচরণ, কাব্যবর্ণনায় আঙ্গিকের বারংবার পরিবর্তন সাধন এবং শব্দচয়ন ও অন্ত্যমিলে এ কাব্যখানি কবির অসাধারণ বৈদগ্ধ্য, কাব্যরুচি ও কাব্যবোধকেই ধারণ করে আছে।

মোবাশ্বের আলী উল্লেখ করেন যে, রূপজালাল ‘একখানি আধুনিক ধরনের পুথি’। এতে গতানুগতিক ধারার কাহিনী অনুসরণ করা হয়নি, সেই সাথে রূপকের মাধ্যমে রূপকথার কাহিনী ব্যক্ত করা হয়েছে। বস্তুত এ গ্রন্থের একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, এতে আত্মকথন ছলে লোক-মানসের বিশাল ও জটিল কল্পনা জগেকও উৎসারিত করা হয়েছে (তুলনীয়: ‘এর কাহিনীর পট সুবিস্তৃত ও ঘটনাজাল জটিল’। আনিসুজ্জামান); এবং কেবল আত্মজীবন প্রসঙ্গই নয়, এ-কাব্যের কাহিনীর অন্তরালেও [অর্থাৎ শীমাইল রাজ্যের কুমার জালাল এবং রাক্ষসপুরীতে বন্দিনী রূপবানুর ছায়াতলে] কবি আপনার জীবনের বিচ্ছেদের কথা ও এই অপরিতৃপ্তির একটি বাঞ্ছিত পরিণতিকে কল্পনা করেছেন। বাস্তবে যা ঘটে না, ঘটবার নয়, কল্পনায় তাকে সম্ভব করে তোলাই মানব মনের একটি প্রবণতা। সেখানেই তার আশা নিয়ে বেঁচে থাকার সার্থকতা। ফয়জন্নেছাও তাই এই কথা বলতে গিয় একটি নিটোল রূপকাহিনী নির্মাণ করেছেন, যার আদর্শ তিনি পেয়েছিলেন আবাল্য লোক-কথা শোনার অভিজ্ঞতা এবং মধ্যযুগের কাব্য থেকে। এক কথায় বলা যায় গ্রন্থখানি রূপক এবং রূপকথাশ্রয়ী। বলা হয় এ-গ্রন্থে যুগসন্ধির প্রকাশ ঘটেছে। এ-কথা অবশ্য সত্য যে, আত্ম-হাহাকার ও নিরঙ্কুশ সৌন্দর্যচেতনা দ্বারা এ-কাব্যের নির্মিতি ঘটেনি। এ-কাব্যের সামগ্রিক কাঠামো ও রচনার ধারায় তাই ভিন্নপ্রবণতা পরস্ফুিট। আনিসুজ্জামান (১৯৮৩: ১৭৭-৭৯ পৃষ্ঠা) চমত্কার বিশ্লেষণ দ্বারা দেখিয়েছেন, এ-কাব্যের নানা সাহিত্যের প্রভাব আছে। (গল্পে, গ্রন্থি উন্মোচন প্রক্রিয়ায়, চরিত্র নির্মাণে এবং ছন্দভঙ্গির অনুসরণে), কিন্তু তথাপি তা মৌলিকতায় লক্ষণাক্রান্ত। প্রভাবকে অনায়াসে অতিক্রমের ক্ষমতা তিনি আয়ত্ত করেছিলেন। এ-কাব্য তাই তাঁর নিজস্ব তথা মৌলিক সৃষ্টি। এই অর্থেই তিনি ‘প্রাচীন ধারার হয়েও ব্যতিক্রমী’।

ফয়জন্নেছা মধ্যযুগে কাব্যাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, (দ্রষ্টব্য, আনিসুজ্জামান, মোবাশ্বের আলী, আবু তালিব), কিন্তু তবু আধুনিক জটিলতাকেও এড়াতে চাননি। তাঁর মালিনী প্রভৃতি চরিত্র এবং কাহিনীর পরিণতি ‘অনিবার্যভাবে’ ভারতচন্দ্রীয়, কাহিনী ও প্লট-বন্ধনও পুথিরীতিক, কোথাও কোথাও তা লোক-কাহিনীসম্মত—কিন্তু এ-সবের মধ্য দিয়ে আসলে তিনি বাংলা কাব্যের প্রসারিত ও সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকেই এ-ভাবে ধারণ করেছেন। এখানেই তাঁর মধ্যে একটা প্রাগ্রসরতার ও মুক্ত চিন্তার প্রকাশ লক্ষ করি। শুধু কাহিনী বা চরিত্র কিংবা প্লটই নয়—তাঁর ভাষায় ও ছন্দে শব্দ ব্যবহারে এবং পুরাণাদির প্রসঙ্গ ও লোক-উপাদানের বিস্তারে ফয়জন্নেছার মধ্যে একটা সর্বজনীনতা ও ব্যাপক পাঠাভ্যাসের পরিচয় লক্ষ করা যায়। এই অধীত জ্ঞান এবং মানব চরিত্র সম্পর্কিত অন্তর্দৃষ্টি ও অভিজ্ঞতা (দ্রষ্টব্য, মোবাশ্বের আলী ১৩৮৭: ১০৮ পৃষ্ঠা) তাঁকে যেমন ঐতিহ্য-সংলগ্ন করেছে, তেমনি আত্মপ্রকাশ চৈতন্যকে করেছে অবারিত দ্বার। আর এখানেই তিনি নব পথদ্রষ্টাও। তাঁর মধ্যে এবাদতুল্লাহ কিংবা মোহাম্মদ খাতেরের প্রভাবকেই বড় করে দেখার মধ্যে কোনো গুরুত্ব নেই। মনে রাখতে হবে, কবি নিজেকে ‘আধুনিক লেখিকা’ রূপেই আত্মপরিচয় দিয়েছেন।

ফয়জন্নেছার ‘আধুনিক’ চেতনার বিশেষ পরিচয়টি পাই পূর্ব-কথিত ‘আত্মকথন’-এর চেষ্টার ভিতর। তাঁর সমসাময়িক কালে এই আত্মকথন ও তত্ছলে আত্মবেদনার প্রকাশরূপটি তখনও পূর্ণ সাহিত্যিক মর্যাদালাভ করতে পারেনি। বিহারীলালের ‘সারদা মঙ্গল’-এর প্রকাশ তখনও অপেক্ষিত; এবং তাঁর কাব্যের চিত্ত সৌন্দর্যও আত্ম-বেদনার আলোড়ন (যথা, ‘আমি যেন একেবারে কি হয়ে গেলাম’) সমকালকে বিন্দুমাত্রও স্পর্শ করেনি।

এখানে উল্লেখ্য, এ-সময় বিহারীলাল যে একটি নতুন সুরের প্রবর্তন করেন সে-কথা উনিশ শতকের শেষভাগে এসে রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছিলেন। তার আগে তাঁর কবিতাগুলি সম্পর্কে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া কেউ আবশ্যক বিবেচনা করেননি। বিহারীলাল কবিতার মালা সৃষ্টি করেন ও সেগুলি বর্গবদ্ধ করে কখনো প্রিয় প্রসঙ্গে, কখনো অস্পষ্টকায় আরাধ্য মনোদেবীর ধ্যানে উত্প্রকাশ করেন। মূল সূত্রটি ছিল অকারণ অতৃপ্ত বেদনা এবং চেষ্টা ছিল হু হু করা মনের ফ্রেমে তাকে বাঁধবার। ‘রূপজালাল’ কাব্যের যে অরন্তুদ বিষাদ, আত্মহাহাকার এবং অতৃপ্ত রসাকাঙ্ক্ষা, তাও ছিল ‘আধুনিক লেখিকার’-ই উপযোগী—

দিবস যামিনী এই বিরহিনী

প্রাণ প্রিয় প্রিয় কয়\

অর্থাৎ এর মধ্যেও দেখি সেই একই মনোরঙ্গ, আত্ম-মানবিক একাকারকৃত দুঃখ—‘সর্বদাই হু হু করে মন। বিশ্ব যেন মরুর মতন’। তবে বিহারীলালের কাব্যে এই বোধের উৎসার থাকলেও এর কোনো চরিতার্থতার সন্ধান ছিল না। সৌন্দর্যময় পরিপ্রেক্ষিত ছিল, কিন্তু ব্যক্তিক আকাঙ্ক্ষাগুলি স্থির কামনায় রূপ নেয়নি, বরং সমীকরণ খুঁজছে—‘বুঝিলেই নেভে আলো। বা বুঝিয়া থাকা ভালো’। অন্যদিকে ‘রূপজালালে’ রূপকথার অবাস্ততবতার মধ্যেও ব্যক্তিকামনার প্রক্ষেপ আছে, অসম্ভবকে সম্ভব করার উদগ্র ইচ্ছাই সেখানে স্পষ্ট, তার আন্তরিক প্রকাশটাই সেখানে মুখ্য। এই অর্থে তা অধিক বাস্তব, প্রত্যক্ষ বোধে আত্মগত। এই দিক থেকে দ্বীজেন্দ্রনাথের উদ্ভট রূপকথা ও চিত্রকল্পের থেকেও তা স্বতন্ত্র এবং বিশিষ্ট। আর কবির কলাকৌশলগত সচেতনতার কথা তো আগেই বলা হয়েছে। তাঁর কবিতা থেকে আরো কিছু উদাহরণ দিলে কথাটা পরিষ্কার হবে—

আহা প্রভো নিদয় কেন দুঃখ পরে দুঃখ হেন

মহাপাপ হেন কি করেছি

আহা প্রভো অকারণ বারে বারে বিরম্বণ,

বৃথাকর পূর্বেই মরেছি\

আহা প্রভো যেইক্ষণে, হরে নিলে পতিধনে,

তদবধি আছি মৃতপ্রায়।

আহা প্রভো হেন করে, কেন বৃথা ভবপুরে,

রেখেছ এ শূন্য করি কায়\

গান

হূদয় যাতনা সখী, কভু প্রকাশিতে নারি।

মুকের স্বপন প্রায় গুমরে গুমরে মরি\

প্রাণ জ্বলে নিরন্তর কে বুঝিবে দুঃখান্তর।

তা ভেবে অন্তরান্তর ভবে বৃথা জীবন ধরি\১

যার জন্য দহে অন্তর সে মম রৈল অন্তর।

সর্ব্বদা আকুল অন্তর বল কি উপায় করি\২

কাহিনী সংক্ষেপ

শীমাইল অধিপতি জামালের পুত্র জালাল। তার জন্মগ্রহণের পর ভবিষ্যৎ গণনায় জানা যায় যে, বিদেশে মৃত্যু তুল্য কষ্ট পাবে তবে ‘আয়ু বলে কষ্ট সারি স্বদেশে আসিবে।’

জালাল নানা শাস্ত্রে বিশারদ হয়ে যৌবনে উপনীত হলে যোগ্য পাত্রীর সাক্ষাৎ পাওয়া ভার হল। ফলে মৃগয়াচ্ছলে সুপাত্রীর অন্বেষণে জালাল ওমরানগরে এসে উপস্থিত হয় এবং সখীবৃন্দসহ সাধু-কন্যা রূপবানুকে দেখতে পায়। ‘উভয় পতিত ভূমে উভয়ে হেরিয়ে’। অপ্রকৃতস্থ পুত্র দেশে ফিরলে রানী রূপবানুর খোঁজে দূতী নিয়োগ করেন। এদিকে বিরহিণী রূপবানু ফোরতাস রাক্ষস কর্তৃক হল অপহূতা। দূতী জালাল-বাঞ্ছিতার খোঁজে বেরিয়ে এক মালিনীর সাথে পরিচিতা হয়ে শেষে রূপবানুর খবর পায়। কুমারকে মালিনী তার মন পরিবর্তনের চেষ্টা করে, মেয়েদের নিন্দা শোনায়—কিন্তু কুমার রাক্ষস-হত্যার সংকল্প নেয়।

এই সময় মুগ্ধ পরীকন্যা গোলচেহেরা তাকে রথে করে নিয়ে যায়, কিন্তু পরী-রানী কর্তৃক তাকে শেষ পর্যন্ত সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত করা হয়। এখানে খোয়াজ খিজিরের সাক্ষাৎ পেয়ে তাঁর দেওয়া ‘ইসিম’-এর সাহায্যে হীরামন-পাখি বধ করে রাক্ষস প্রাণ নাশ করে।

এরপর কুমার ঝমঝম রাজ্যে বন্দী হয়। পরে দেশে যাওয়ার অধিকার পাওয়ার শর্তে রাজকুমারীকে বিয়ে করে মুক্ত হয়। এখানে রূপবানু-দূতীর সাক্ষাৎ পেলে সে বেরিয়ে পড়ে এবং আবার এসে রাজকুমারী হুরবানুকে নিয়ে যাবে কথা থাকে। কিন্তু নৌকার ছাদ থেকে এক রকপাখি তাকে নিয়ে যায় এবং নানা বিপদের ভিতর যাদুর পাহাড়ে এবং যাদুকন্যার হাতে আবার বন্দী হয়। এই কন্যার সখীর কাছে কৌশলে মন্ত্র আয়ত্ত করে পরে সে যাদুর পাহাড় অতিক্রম করে।

এই সময় মানবিক কারণে একটি ঘটনার সাথে সে যুক্ত হয়। দৈত্যরাজ আরদবেলের পুত্র দিগবিজয় তাতার দেশীয় রাজকন্যাকে বাধ্য হয়ে বিয়ে করলে তার পূর্ব প্রণয়িনী গন্ধর্বরাজ সমসেরের কন্যা মাহেমণি ক্রোধান্বিত হয়ে তার প্রাণ হরণ করে এক কূপে নিক্ষেপ করে। জালাল সেই কূপ থেকে তার জীবন ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে সমসের নগর যাত্রা করে। পথে দানবেশ্বর হুমুর কন্যা শুধাংশুবদনী ও তার প্রণয়ীকে বন্দী দশা থেকে মুক্ত করে। এক মুনির সাহায্যে রায়হান রাজার ছেলেদেরও উদ্ধার করে। সকলের সাহায্য নিয়ে প্রাগুক্ত কূপ থেকে জীবন নিয়ে দিগবিজয়কে পুনর্জীবিত করে। দিগবিজয় দুই পত্নী নিয়ে সুখে সংসার করতে থাকে।

কুমার জালাল এরপর দেশে ফিরে গিয়ে রূপবানুকে বিবাহ করে এবং সেও হুরবানু ও রূপবানুকে নিয়ে সোনার সংসার গড়ে তোলে।

 

রচনাটি মনিরুজ্জামান রচিত ফয়জন্নেছা চৌধুরাণী গ্রন্থ থেকে লেখকের অনুমতিক্রমে সংকলিত

 

ড. মনিরুজ্জামান: সাবেক অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ভাষা ও লোকসাহিত্য গবেষক। ভারত ও ইংল্যান্ডের বিভিন্ন ভাষাতাত্ত্বিক সংগঠনের আজীবন সদস্য


শর্টলিংকঃ