নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের চিকিৎসার সম্ভাবনা


চীনের উহান শহরে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রথম শনাক্ত হওয়া নভেল করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের প্রায় সব দেশ ও অঞ্চলে। বিশ্বখ্যাত ন্যাচার মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় স্পষ্ট হয় যে, সার্স-কোভ-২ ভাইরাস ল্যাবরেটরিতে অর্থাৎ কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি হয়নি। মানুষের শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণের জন্য দায়ী সাতটি করোনাইভাইরাসের মধ্যে তিনটি করোনাভাইরাস, সার্স-কোভ, মার্স-কোভ ও সার্স-কোভ-২ মারাত্মক ক্ষতিকর।

অন্য চারটি করোনাভাইরাস তেমন ক্ষতিকর নয়। সার্স-কোভ ও মার্স-কোভ—এ দুটি ভাইরাসের সঙ্গে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটি খুব ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত ও একই গোত্রের। ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০২ সাল থেকে বিশ্বের ৩৭ টি দেশে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া সার্স-কোভ নামক করোনাভাইরাসের সংক্রমণে পৃথিবীতে ৭৫০ জনের অধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এবং ৮০০০ জনের অধিক সংক্রমিত হয়েছিল।

মার্স-কোভ করোনাভাইরাস তুলনামুলক ধীরে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়েছিল, তবে প্রাণঘাতীর হার ব্যপক ছিল। মার্স-কোভ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ২,৫০০ জন মানুষের মধ্যে ৩৫% মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর সিস্টেমস সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসএসই) প্রদত্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে কোভিট-১৯ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ২০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে ও মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ৩৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। পূর্বের করোনাভাইরাসজনিত দুইটি মহামারির চেয়ে বর্তমান কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাস বিশ্বব্যাপী অনেক বেশী সংক্রমণ, মৃত্যু ও অর্থনৈতিক মন্দার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সার্স-কোভ-২ আক্রান্ত ব্যক্তির প্রধান সাধারণ লক্ষণগুলো হচ্ছে- জ্বর, ক্লান্তি, ও শুষ্ক কাশি। বয়স্ক ব্যক্তিরা এবং যাদের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ফুসফুসে সমস্যা বা ডায়াবেটিস রোগ আছে, তাদের কোভিড-১৯ রোগে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হওয়ার বিশাল ঝুঁকি রয়েছে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, যে কোনো বয়সের লোকই নতুন এ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। সিএনএন হেলথ ৩১ মার্চ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, কিছু শিশুসহ ২০-৫০ বছর বয়স্ক অসংখ্য মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯ থেকে প্রতিরক্ষার জন্য ইতোমধ্যে নিম্নোক্ত তিনটি গুরুত্বপূর্ন সুপারিশ করেছে।

১. কোভিড-১৯ এর বিস্তার রোধের সবচেয়ে সহজ, সাশ্রয়ী ও কার্যকর উপায়গুলোর একটি হলো ভাইরাস নির্মুলে ঘনঘন সাবান (অন্তত ২০ সেকেন্ড সময়) বা ৬০-৮০% অ্যালকোহলসমৃদ্ধ হ্যান্ডস্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিস্কার করা।

২. মুখে ও নাকে মাস্ক ব্যবহারের মাধ্যমে কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি/কাশির ভাইরাস ধারণকৃত তরল ক্ষুদ্র ড্রপলেট থেকে নিজেকে রক্ষা করা।

৩. হাঁচি/কাশির ভাইরাস থেকে নিজেকে রক্ষার্থে অন্য মানুষ থেকে অন্তত ১ মিটার (৩ ফুট) দূরত্ব বজায় রাখা।

বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশে কোভিট-১৯ মারাত্মক আকার ধারণ করায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে দেশগুলোতে সামাজিক শিষ্টাচার, শারীরিক দূরত্ব, কোয়ারেন্টাইন (আক্রান্ত ও সম্ভাব্য আক্রান্ত মানুষ থেকে সুস্থ মানুষকে বিচ্ছিন্ন রাখা) বা লকডাউন চলছে।

কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্তের প্রায় ১৫ শতাংশ ইতোমধ্যে মারাত্মকভাবে ফুসফুসের নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়েছে। নতুন ড্রাগ আবিস্কারে অনেক সময় লেগে যেতে পারে বিবেচনায়, বর্তমানে বিশ্বের গবেষকগণ অন্য রোগের জন্য ইতোপূর্বে অনুমোদনকৃত ব্যাপক নিরাপদ ড্রাগগুলো কোভিট-১৯ রোগ নিরাময়ের জন্য পুনঃপরীক্ষণ করছেন।

বিশ্বের গবেষকগণ কোভিট-১৯ চিকিৎসায় পাঁচটি সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ওষুধ পরীক্ষার জন্য গুরুত্ব দিচ্ছেন (সূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক চিকিৎসা সাময়িকী ‘লাইভসায়েন্স’)। সেগুলো হলো–১) এন্টিভাইরাল কমপাউন্ড রেমডেসিভির; ২) ম্যালেরিয়ার ওষুধ ক্লোরোকুইনিন ও হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনিন; ৩) অ্যান্টি-এইচআইভি কমবিনেশন ড্রাগ লোপিনাভির ও রিটোনাভির; এবং ৪) অ্যান্টি-এইচআইভি কমবিনেশন ড্রাগ লোপিনাভির ও রিটোনাভির প্লাস ইন্টারফেরন-বেটা ৫) জাপানের এন্টি-ফ্লু ড্রাগ ‘ফ্যাভিপিরাভির’।

এন্টিভাইরাল কমপাউন্ড রেমডেসিভির

রেমডেসিভির ড্রাগ মূলত ইবোলা ও সংশ্লিষ্ট ভাইরাসগুলোকে প্রতিহত করতে আমেরিকার জিলেড সায়েন্সেস কর্তৃক আবিষ্কৃত হয়েছিল। সায়েন্স ট্রান্সলেশনাল মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় গবেষকগণেরা দেখিয়েছেন, টেস্ট টিউবে সেল কালচার ও ইদুরের দেহে পরীক্ষায় রেমডেসিভির ড্রাগ সার্স ভাইরাসের রেপ্লিকেশন এনজাইমকে বাধাগ্রস্থ করে ভাইরাসের বংশবিস্তার ব্যহত করতে সক্ষম হয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মেডিক্যাল নিউজ সাইট ‘স্টাট’ সম্প্রতি রিপোর্ট করেছে, রেমডেসিভির কোভিড-১৯ রোগের সংক্রমণ হ্রাস করতে পারে কিনা- এ বিষয়ে বর্তমানে যুক্তরাস্ট্র ও চীনে পাঁচটি ক্লিনিকাল পরীক্ষা (ক্লিনিকাল ট্র্যায়াল) চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থার ধারণা, রেমডেসিভির ড্রাগ কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য বর্তমান গবেষণায় ফলপ্রসূ হবে।

ক্লোরোকুইনিন ও হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনিন

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৩ মার্চ, ২০২০ তারিখে কোভিড-১৯ বিস্তার রোধে অনেক দেশের ক্লোরোকুইনিনের প্রতি আগ্রহ বিবেচনা করে অধিকতর পরীক্ষার বিষয়ে গুরুত্ব দেন। ২০০২-২০০৩ সালের মহামারির জন্য দায়ী সার্স-কোভ ভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তার রোধে ক্লোরোকুইনিন কার্যকর হয়েছিল (সূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক চিকিৎসা সাময়িকী ‘লাইভসায়েন্স’)।

ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০২-২০০৩ সালের মহামারির জন্য দায়ী ভাইরাস সার্স-কোভ ও ২০১৯-২০২০ সালের মহামারি কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাস সার্স-কোভ-২ এর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উল্লেখ করেছে, চীনে ক্লোরোকুইনিন ও হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনিন ড্রাগস ব্যবহার করে কোভিড-১৯ সম্পর্কে ২০টির বেশি ট্র্যায়াল/পরীক্ষা হয়েছে।

ইউ এস সোসাইটি অফ ক্রিটিক্যাল কেয়ার প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, মারাত্মক অসুস্থ কোভিড-১৯ রোগীদের ক্লোরোকুইনিন ও হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনিন ব্যবহারের উপকারের বিষয়ে পর্যাপ্ত প্রমাণ নাই। ইউনিভার্সিটি অফ কালিফোর্নিয়ার রোগ সংক্রমণ বিশেষজ্ঞ ডেভিড স্মিথ কোভিড-১৯ রোগের বিষয়ে ক্লোরোকুইনিন ও হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনিনের উপর আরোও গবেষণার বিষয়ে গুরুত্ব দেন।

রিটোনাভির ও লোপিনাভির কমবিনেশন

এন্টি-এইচআইভি কমবিনেশন ড্রাগ রিটোনাভির ও লোপিনাভির এইচআইভি ভাইরাস বংশবিস্তারের সময় ভাইরাসের প্রোটিয়েজ নামক গুরুত্বপূর্ন এনজাইমকে বাধাগ্রস্থ করে প্রোটিন ভাঙাকে বন্ধ করতে এই কমবিনেশন ড্রাগ খুবই কার্যকর। এই কমবিনেশন ড্রাগ করোনাভাইরাসের প্রোটিয়েজ এনজাইমকেও বাধাগ্রস্থ করতে পারে।

দ্য জার্নাল অফ ইনফেকশাস ডিজিজেসের প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধে জানা গেছে, এই কমবিনেশন ড্রাগ মার্স করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে কার্যকর ছিল। তবে দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন এ প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধে জানা গেছে, চীনের উহান শহরের হাসপাতালে মারাত্মক কোভিড-১৯ আক্রান্ত ১৯৯ জন রোগীকে রিটোনাভির ও লোপিনাভির কমবিনেশন ড্রাগ দিয়ে চিকিৎসায় কোন সুফল পাওয়া যায় নাই। উহানের উক্ত গবেষণায় গবেষকগণ অনুমান করছেন, এই কমবিনেশন ড্রাগের চিকিৎসা অনেক বিলম্বে রোগীদের মারাত্মক ক্রিটিকাল অবস্থায় আরম্ভ হওয়ায় সুফল আসে নাই।

রিটোনাভির , লোপিনাভির এবং ইন্টারফেরন-বেটা কমবিনেশন

দ্য জার্নাল অফ ইনফেকশাস ডিজিজেসের প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধে জানা গেছে, তিনটি ড্রাগের সমন্বয়ে রিটোনাভির, লোপিনাভির এবং ইন্টারফেরন-বেটা কমবিনেশন ড্রাগ মার্স করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে কার্যকর ছিল। ইন্টারফেরন-বেটা রোগ প্রতিরোধের বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করে যা ভাইরাসকে বিকল করতে সহযোগিতা করতে পারে। সম্প্রতি ‘ট্রায়ালস’ জার্নালের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সৌদি আরবে এই তিনটি ড্রাগের সমন্বয়ে প্রথম মার্স-কোভ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষা চলছে।

জাপানের এন্টি-ফ্লু ড্রাগ ফ্যাভিপিরাভির

জাপানী কোম্পানি ফুজি ফিল্মের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান তোয়ামা কেমিক্যাল ইনফ্লুয়েঞ্জার চিকিৎসার জন্য তৈরি করেছিল ‘ফ্যাভিপিরাভির’। ফার্মাসিউটিক্যাল টেকনোলজি নিউজ সাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্ত মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ঝাং শিনমিন বলেছেন, জাপানের এন্টি-ফ্লু ড্রাগ ফ্যাভিপিরাভির ড্রাগ কোভিড-১৯ নিরাময়ে কার্যকর হবে।

চীনের উহান ও শেনজেন শহরে করোনায় সংক্রমিত ৩৪০ জন রোগীর ওপর প্রয়োগ করে আশাব্যঞ্জক ফল পাওয়া গেছে। চীনের কর্মকর্তা ঝাং শিনমিন বলেন, ‘ওষুধটি যথেষ্ট নিরাপদ এবং রোগ সারাতে নিশ্চিতভাবে এটি কার্যকর।’ এই ড্রাগটি ভাইরাসের রেপ্লিকেশন (অনুলিপন) বাধাগ্রস্থ করে বংশ বিস্তার ব্যহত করে এবং আক্রান্ত মানুষের ফুসফুসের উন্নতি ঘটায়।

যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক চিকিৎসা সাময়িকী ‘লাইভসায়েন্স’ জানিয়েছে, ফ্যাভিপিরাভির অন্তত মৃদু থেকে মাঝারি কোভিড-১৯ আক্রান্তদের চিকিৎসায় সম্ভাবনাময় ড্রাগ।

লেখক: প্রফেসর ড. মু. আলী আসগর , রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


শর্টলিংকঃ