পরীক্ষায় মানোত্তীর্ণ নয় রাজশাহী ওয়াসার পানি


জিয়াউল গনি সেলিম :

বিশুদ্ধ পানির প্রতিশ্রুতি দিয়ে দূষিত পানিই সরবরাহ করছে রাজশাহী ওয়াসা। ল্যাবরেটরির পরীক্ষাতে মান উত্তীর্ণ নয়, অথচ সে পানিই নগরবাসীকে দিব্যি খাওয়াচ্ছে তারা।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে পারেন সাধারণ মানুষ। যদিও নিজেদের সরবরাহ করা পানি পান করেন না খোদ ওয়াসার কর্মকর্তারাই।

ওয়াসার তথ্য বলছে, নগরীতে সাড়ে ৫লাখ মানুষের জন্য দৈনিক পানির চাহিদা ১১কোটি ৩৩লাখ লিটার। এর বিপরীতে তারা সরবরাহ করছে সাড়ে ৯ কোটি লিটার। এরমধ্যে ৯৪ভাগই মিলছে ভূ-গর্ভস্থ পানি। যা গভীর নলকুপের মাধ্যমে তুলে সরবরাহ করা হচ্ছে, প্রায় একশ’ বছর আগে স্থাপিত পাইপ লাইনের মাধ্যমে। আর বাকি ৬শতাংশ পানির যোগান আসছে পদ্মা থেকে। নদীর পানি তুলে শোধনের পর তা ছাড়া হয় এই পাইপ লাইনেই।

ওয়াসা জানিয়েছে, পানির গ্রাহক সংখ্যা ৪২হাজার ৬৮০টি। বাৎসরিক বিল সাত কোটি ৮২লাখ ৪৩ হাজার টাকা। এরমধ্যে আদায় হয়ে থাকে পাঁচ কোটি ৭লাখ ৪২লাখ টাকা।পানি সরবরাহের জন্য পাইপলাইন নেটওয়ার্ক রয়েছে ৭১২দশমিক ৫০কিলোমিটার। আর পানি উত্তোলন করা হয় ১০৩টি নলকূপে। গড়ে দৈনিক একজন মানুষ পানি ব্যবহার করেন ১৩৫.৭০লিটার। আর দৈনিক জন প্রতি  ওয়াসা উৎপাদন করে ২০৫লিটার। প্রতি এক হাজার লিটার পানি উৎপাদনে খরচ পড়ে ৭.৮৮টাকা।

ওয়াসার পানি শোধনাগার

নগরীর খাবার পানির মান নিয়ে ২০১৬সালে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য গবেষণা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক।গবেষণায় উঠে এসেছে, আর্সেনিক সহনীয় মাত্রায় থাকলেও ম্যাঙ্গানিজ, আয়রণ ও হার্ডনেসের মাত্রা স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকারক। তবে এত কিছু না বুঝলেও ওয়াসার পানিতে আস্থা নেই সাধারণ মানুষের।

নগরীর বিভিন্ন এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাসাবাড়িতে ওয়াসার সরবরাহ করা পানি খান না তারা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চাপ কলের (হস্তচালিত নলকূপ) পানি খান। তবে রান্না, গোসল, কাপড় কাচাসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে এই পানিই ব্যবহার করেন। অনেকেই আবার সাবমারসিবল পাম্প বসিয়েছেন নিজ উদ্যোগেই। এর বাইরে সাধারণ হোটেলগুলোতে ওয়াসার পানিই ভরসা। নিম্নআয়ের মানুষ সরবরাহ করা পানিই পান করছেন।

পদ্মার পানি তুলে শোধন করে ছাড়া হয় পাইপ লাইনে

সবশেষ ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে দিয়ে পানির মান পরীক্ষা করিয়েছিল রাজশাহী ওয়াসা। এতে দেখা যায়, ওয়াসার পানিতে প্রতি লিটারে সর্বোচ্চ হার্ডনেস মিলেছে ৩৫০ থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম। বাংলাদেশে এর স্বাভাবিক মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ ৫০০ মিলিগ্রাম। প্রতি লিটারে আইরন থাকার কথা ০.৩ থেকে ১.০ মিলিগ্রাম। কিন্তু এখানে সর্বোচ্চ পাওয়া গেছে ৪.৬০ মিলিগ্রাম। প্রতি পানিতে ০.১ মিলিগ্রাম ম্যাঙ্গানিজের উপস্থিতিকে স্বাভাবিক মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু রাজশাহী ওয়াসার পানিতে এই মাত্রা সর্বোচ্চ ২.১৬ মিলিগ্রাম। তবে পাইপ লাইনে প্রাণির মল-মূত্রের উপস্থিতির বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখে নি ওয়াসা।

নিজেদের সরবরাহ করা পানি শতভাগ বিশুদ্ধ নয় বলে জানিয়েছেন ওয়াসার কর্মকর্তারাই। এ তারাও এ পানি খান না। এ বিষয়ে রাজশাহী ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (প্রকৌশল) একেএম আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের পানি উৎসে কোনো সমস্যা নেই। গভীর নলকূপগুলো থেকে বিশুদ্ধ পানিই উঠছে। কিন্তু সমস্যা হলো, পাইপ লাইনগুলো বহু বছরের পুরনো। এ কারণে  কোথাও কোনো লিকেজ থাকতেও পারে। লিকেজ থাকলে নানা ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। এছাড়া, পাইপগুলো মরিচা বা জং ধরে গেছে। এতে পানির মান ঠিক রাখা সম্ভব নয়।

 

বিশিষ্ট পানি গবেষক অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারোয়ার জাহান

তবে সরকারের পানি বিষয়ক টাস্কফোর্সের সদস্য অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারোয়ার জাহান বলেন, রাজশাহীর পানিতে আর্সেনিকের চেয়েও ভয়াবহ মাত্রায় রয়েছে ম্যাঙ্গানিজ ও হার্ডনেস। প্রচুর মানুষ হোটেলে ওয়াসার পানিই খাচ্ছেন। এর বাইরে নগরীর প্রান্তিক ওয়ার্ডগুলোতে নিম্নআয়ের মানুষও এই পানি খাচ্ছেন। সংসারের নানা কাজে ব্যবহারও করছেন।

তিনি আরো বলেন, ‘পানির মান নিশ্চিত করতে না পারলে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন পানি ব্যবহারকারীরা। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পুরনো পাইপ লাইন আধুনিকায়ন ও নিয়মিত পানির মান পরীক্ষা ছাড়া পথ নেই’।

বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের লক্ষ্য নিয়ে ২০১০সালে রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠিত হয় ওয়াসা। এর আগ পর্যন্ত পানি সরবরাহের কাজটি করতো সিটি কর্পোরেশন।

 


শর্টলিংকঃ