পাউবো’র সেই দাপুটে প্রকৌশলীকে রক্ষায় কি বার বার তদন্ত?


নিজস্ব প্রতিবেদক : 
টেন্ডার জালিয়াতির অভিযোগে প্রত্যাহার করা হয়েছিল রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী কোহিনুর আলমকে। প্রায় অর্ধকোটি টাকার টেন্ডারে জালিয়াতির অভিযোগ ওঠার পর ঢাকায় তাকে পানিভবনে সংযুক্ত করা হয়। এরপর শুরু হয় তার অনিয়মের তদন্ত। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, ঢাকায় বসেই তদন্ত কার্যক্রম প্রভাবিত করছেন কোহিনুর আলম। খোদ রাজশাহী পাউবোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরই এমন অভিযোগ। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গেল বছর রাজশাহী শহর বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের ৪৯ লাখ ৯৯ হাজার টাকার একটি টেন্ডারের কাজ পান একজন ঠিকাদার। এই টেন্ডার টেম্পারিং করার অভিযোগ পড়ে পাউবোর মহাপরিচালকের কাছে। এছাড়া অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কোহিনুর আলমের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ এনে সরকারি বিধি মোতাবেক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করেন। এরপর দুই দফা তদন্ত হয়েছে। কিন্তু ওই তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে নি। বরং আগের তদন্ত প্রতিবেদন বাতিল ঘোষণা করে নতুন আরেক কর্মকর্তাকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

জানা গেছে, নির্বাহী প্রকৌশলী কোহিনুর আলমের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের প্রথম তদন্তটি করেন পাউবোর তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান। তিনি তদন্ত প্রতিবেদনও জমা দেন। এরপর আরেক তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সাইফুল হোসেনকে দিয়ে অভিযোগের তদন্ত করা হয়। সাইফুল ইসলাম অভিযোগকারী আসাদুল্লাহ জাহাঙ্গীর ও নূর-ই আলম সিদ্দিকীর সাক্ষাতকার গ্রহণ করেন।

রাজশাহী পাউবোর একজন উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী তদন্ত কর্মকর্তাকে জানিয়েছেন, কোহিনুর আলমের অনৈতিক কাজে সহায়তা না করার কারণে তার বহিরাগত সন্ত্রাসীরা অফিসে এসে তাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে। ওই সময় তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
ভয়াবহ তথ্য দিয়েছেন রাজশাহী পাউবোর একজন প্রাক্কলনিক। তিনি বলেছেন, টেন্ডার জালিয়াতিতে সহায়তা করার জন্য কোহিনুর আলম জন্মাষ্টমির ছুটির দিনে ওই নারী কর্মকর্তাকে অফিশিয়াল কাজের কথা বলে অফিসে ডাকেন। এরপর ৮-১০ জন বহিরাগত সন্ত্রাসী এবং নির্বাহী প্রকৌশলী কোহিনুর আলম তাকে চাপ দেন যেন তিনি আরেকটি দরপত্রের জাল প্রাক্কলনে স্বাক্ষর করেন। ওই কর্মকর্তা সেদিন অফিস ত্যাগ করে ভয়ে পরে অফিসে ছুটির আবেদন করেন।

তদন্ত কর্মকর্তা উচ্চমান সহকারী মমতাজ উদ্দিনকে অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করার একটি অডিও ক্লিপও জব্দ করেন। অনৈতিক কাজে সহায়তা না করার কারণে নির্বাহী প্রকৌশলী তাকে এভাবে গালিগালাজ করেছিলেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তদন্ত কর্মকর্তার কাছে কোহিনুর আলমের বিরুদ্ধে মোট ১০টি অনিয়মের অভিযোগের কথা তুলে ধরেন। এর মধ্যে ঊর্ধ্বতন হিসাব সহকারী আনোয়ার হোসেন ও হিসাব করণিক রিপন কুমার লিখিতভাবে তদন্ত কর্মকর্তাকে জানান যে, নির্বাহী প্রকৌশলী কোহিনুর আলম তাদের গুলি করে মারারও হুমকি দিয়েছেন।

অভিযোগে আরও বলা হয়,  কোহিনুর রাজশাহীতে যোগদআনের পর মন্ত্রী-এমপির নাম ভাঙিয়ে একের পর এক অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। কোনো কর্মচারী তার বেআইনি ও অবৈধ কাজে সহযোগিতা করতে না চাইলে তাকেই অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করতেন। কোনো কর্মচারী প্রতিবাদ করলে তাকে স্থানীয় সন্ত্রাসী মাস্তান দিয়ে ভয়ভীতি দেখাতেন।

দু’দফা তদন্তে এসব উঠে এলেও গত ১০ ডিসেম্বর পাউবোর শৃঙ্খলা দপ্তরের পরিচালক আবদুল খালেক এক চিঠিতে আগের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন বাতিল ঘোষণা করে পুনরায় তদন্তের জন্য প্রধান প্রকৌশলী রিভার ম্যানেজমেন্ট দপ্তরের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমানকে দায়িত্ব দেন। ২৪ ডিসেম্বর তিনি রাজশাহী পাউবো এসেছিলেন। কিন্তু ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, মাহফুজুর রহমান ভুক্তভোগী এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সবার সঙ্গে কথাই বলেননি। কাউকে ডাকেন নি। হাতে গোনা যে কয়জনকে ডাকা হয়েছিল তাদের সঙ্গেই তিনি দুর্ব্যবহার করেছেন।

কোহিনুর আলমের বিরুদ্ধে যে ৪৯ লাখ ৯৯ হাজার টাকার টেন্ডারে জালিয়াতির অভিযোগ, সেই কাজের বিলও ইতোমধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে। দুদফায় ঠিকাদার পেয়েছেন প্রায় ৪২ লাখ টাকা। চূড়ান্ত প্রাক্কলন ছাড়া বিল পরিশোধেরই নিয়ম নেই। কিন্তু পাউবোর আঞ্চলিক হিসাব কেন্দ্রের হিসাবরক্ষণ অফিসার সাইফুল ইসলাম বিল পরিশোধ করেছেন। তদন্তের সময় মাহফুজুর রহমান তাকেও ডাকেন নি।

জানতে চাইলে হিসাবরক্ষণ অফিসার সাইফুল ইসলাম বলেন, চূড়ান্ত প্রাক্কলন ছাড়া টেন্ডারই হবে না। তারপরও হয়েছে। এটা অনিয়ম কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবশ্যই অনিয়ম। তারপরও বিল ছাড়ের বিষয়ে জানতে চাইলে সাইফুল বলেন, নির্বাহী প্রকৌশলী কোহিনুর আলমের চাপ ছিল। তিনি বলেছিলেন, টাকা দিয়ে দেন। আমি পরে প্রাক্কলন দিয়ে দেব। কিন্তু তিনি আর প্রাক্কলন দেননি।

সাইফুল ইসলাম আরও বলেন, কোহিনুর আলমের বিরুদ্ধে যে তদন্ত হয়েছে সে সময় আমি এসব বলতাম। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা আমাকে প্রয়োজনই মনে করেননি।ভুক্তভোগীরা বলছেন, কোহিনুর আলমের কথা অনুযায়ী মাহফুজুর রহমান তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। আর এ কারণেই আগের দুই তদন্ত প্রতিবেদন বাতিল করা হয়েছে।

ভুক্তভোগীদের না ডেকে এমন রহস্যময় তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান বলেন, সবাইকে ডাকা হয়নি এটা ঠিক। কিন্তু সবাইকে ডাকতে হবে কেন? আমি কয়জনরে ডাকব? তদন্ত একবার আসে না। আমি পাঁচবারও আসতে পারি। তদন্ত শেষ হয়নি।

তদন্তে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগের বিষয়ে অভিযুক্ত নির্বাহী প্রকৌশলী কোহিনুর আলম বলেন, এগুলো মিথ্যা কথা। আমি টেন্ডারে কোনো অনিয়ম করিনি। কর্মচারীদের সঙ্গে অসদাচরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওসব অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। সন্ত্রাসী ও মস্তান লেলিয়ে দেয়ার অভিযোগও মিথ্যা।


শর্টলিংকঃ