ফতেহপুর সিক্রি ও মোগল নগর পরিকল্পনা


সাম্প্রতিক সময়ে নগর পরিকল্পনার একটি নতুন তত্ত্ব মোগলদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে। ম্যাক্স ওয়েবারের বিবরণের ওপর ভিত্তি করে স্টিফেন ব্লেক ইউরোপীয় রাজধানী শহর ও এশীয় সাম্রাজ্যগুলোর স্বাধীন শহরগুলোর মধ্যে পার্থক্য টেনেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, দিল্লিতে মোগলদের শহর শাহজাহানাবাদ কীভাবে শেষোক্ত রীতিতে বিবর্তিত ও বিকশিত হয়েছে।

তার মতে, এশীয় সাম্রাজ্যগুলো ‘পিতৃতান্ত্রিক-আমলাতান্ত্রিক সাম্রাজ্য’। এগুলোর রূপক অর্থে মূল নিয়ন্ত্রক হচ্ছে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার এবং কেন্দ্রীয় উপাদানটি হচ্ছে রাজকীয় পরিবার। এ থিসিস অনুসারে রাজধানী হচ্ছে বিরাট আকারে বর্ধিত পরিবার। ম্যাক্রো-লেভেলে এটা হচ্ছে সাম্রাজ্যের মিনিয়েচার সংস্করণ। প্রাসাদ ও দুর্গগুলোর অবস্থান শহরের জন্য আর অভিজাতদের মহলগুলো থাকে প্রদেশ, জেলা ও সাম্রাজ্যের অন্যান্য প্রশাসনিক ইউনিটের জন্য। শহরের বিভিন্ন মহল, মসজিদ, দোকানপাট ও বাগানগুলো হচ্ছে প্রাসাদ কমপ্লেক্সের বিস্তৃতি ও প্রতিলিপি।

অন্যভাবে বলা যায়, এশীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী শহর রাজকীয় প্রাসাদ কমপ্লেক্সের একটি বিস্তৃত সংস্করণ মাত্র, যেখানে সবাই সম্রাটের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কে আবদ্ধ। এখানে সম্রাট যেন সন্তানদের পিতার মতো। বাজার, উৎপাদন সম্পর্ক, সাংস্কৃতিক জীবন এবং আরো সব কিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় রাজপরিবার থেকে। এর ফলাফল হচ্ছে ওয়েবারের যুক্তির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। ওয়েবার যুক্তি দিয়েছেন যে, অ-ইউরোপীয় শহরগুলো ইউরোপীয় শহরের মতো নাগরিক স্বায়ত্তশাসন কার্যকর করতে পারেনি। অ-ইউরোপীয় শহরগুলো পৌর স্বায়ত্তশাসন গড়ে তুলতে পারেনি কিংবা নাগরিকদের মধ্যে ভিন্ন একটি শ্রেণী বা সামাজিক গোষ্ঠীর চেতনাও সৃষ্টি করতে পারেনি।

এশীয় সাম্রাজ্যের নগরের এই মডেল কি ফতেহপুর সিক্রির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়? আমাদের জরিপ এ ওয়েবারিয়ান থিসিসকে নাকচ করে দেয়। শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ভিত্তি থাকার পরও ফতেহপুর সিক্রি প্রাক-শিল্পায়িত যুগের লন্ডন থেকে তেমন একটা ভিন্ন কিছু নয়, বিশেষত এর ফাংশনাল এলিমেন্টগুলোর অবস্থান বিবেচনা করলে।

সিক্রির বিরাট হাইড্রোলিক পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, সুপরিকল্পিত রাস্তা ও অলিগলি, অনেকগুলো বাগান, সরাইখানা, শহরতলির নির্দিষ্ট অবস্থান স্পষ্ট করে দেয় যে. মোগল স্থাপত্যবিদরা কেবল নগরের ল্যান্ডস্কেপকে নতুন করে নকশা করছিলেন না, সঙ্গে পাবলিক সার্ভিসের বিষয়গুলোও তাদের মাথায় ছিল। মোগল নগর, রাজকীয় শহরগুলো যে বণিজ্য ও কারুশিল্পের বিকাশমান কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল সে প্রমাণ খুঁজতে ইউরোপীয় ও ঔপনিবেশিক শহরগুলোর নিদর্শনগুলোর সঙ্গে মোগল শহরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনকে তুলনা করতে হবে তেমনটা জরুরি নয়। সমসাময়িক অনেক উৎস ও বিবরণ থেকে বিষয়টি প্রমাণিত হয়। ফতেহপুর সিক্রি রাজকীয় শহর হিসেবে পরিচয় হারানোর পরও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে টিকে ছিল।

আয়তনের ওপর নির্ভর করে মোগল ভারতের শহরগুলো বিভক্ত ছিল ক) বালদা বা শহর, এবং খ) কসবা নামে। কসবা ছোট নগর আর বালদা ছিল বড় শহর।

বালদা হোক কিংবা কসবা, মধ্যযুগের যেকোনো প্রথাগত শহরেই নাগরিক বসতির কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকত। এগুলোর অধিবাসীরা কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিলেন না। নগরের চারদিক ঘিরে থাকত একটা বহিঃদেয়াল (ফাসিল) কিংবা থাকত গভীর পরিখা। আমরা জানি পশ্চিম ইউরোপে ‘টাউন’ বা ‘বার্গ’ টার্মগুলো এসেছে নিরাপত্তা স্থাপনা দিয়ে ঘেরা বড় এলাকাকে নির্দেশ করতে, যেগুলো ‘যুদ্ধের সময় আশ্রয়’ হিসেবে বিবেচিত হতো।

রবার্ট লোপেজ শহরকে চিহ্নিত করেছেন দেয়ালের মধ্যে ‘সংযোগ’ কিংবা ‘সংযোগ সড়ক’ হিসেবে। এ নগরের ধারণা নির্দেশ করে সুরক্ষিত সামাজিক স্থান এবং নগরে আসা বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ। এবার যদি আমরা বিভিন্ন ‘এশীয়’ নগর ও রাজকীয় শহরগুলোর দিকে তাকাই তাহলে দেয়া যাবে, হয় সেগুলো দুর্গব্যবস্থা বা গভীর পরিখা দিয়ে সুরক্ষিত ছিল। ট্রান্স অক্সিয়ানা ও সংলগ্ন অঞ্চল নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বার্টহোল্ড দেখিয়েছেন বালখ, বুখারা ও সমরখন্দে শহর ও শহরতলি ঘিরে আছে প্রাচীর ও ফটক।

মোগল শহরগুলো সাধারণত রণসজ্জা, প্রশস্ত দেয়াল দিয়ে সুরক্ষিত থাকত। লাহোর, আহমেদাবাদ, বারোখ, বারোদা, ক্যাম্বে, সুরাট, শাহজাহানাবাদ ও ফতেহপুর সিক্রি সবই ছিল দেয়ালঘেরা শহর। আজমীর, মুলতান ও কোয়ল (আধুনিক আলীগড়) ছিল একই সঙ্গে দেয়াল ও গভীর পরিখা দিয়ে ঘেরা শহরের উদাহরণ। অন্যদিকে আগ্রা কিংবা উজ্জয়নের মতো শহরে কোনো দেয়াল ছিল না। আগ্রার সুরক্ষায় ছিল কেবল পরিখা। এসব শহর ঘিরে প্রাচীর নির্মিত হয়েছে এই কেবল অষ্টাদশ শতাব্দীতে।

নগর পরিকল্পনার উৎস ও প্রেরণা

মোগল সম্রাটরা প্রায়ই সফরের ওপর থাকতেন (যুদ্ধসহ নানা কারণে- অনুবাদক)। তাই মোগলদের শিবির বা শিবির স্থাপন ছিল তাদের শহর নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রাথমিক অনুপ্রেরণা। ফতেহপুর সিক্রি ছিল মোগলদের প্রথম নির্মিত সুসংগঠিত শহরগুলোর একটি এবং এটি নির্মিত হয়েছিল এমন শিবিরগুলোর গঠন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন নীতি অনুসরণ করে। এমনকি স্থায়ী ফারসি প্রস্তর স্থাপনাগুলোকে বর্ণনা করতে গিয়ে ফারসি উৎসগুলো যে শব্দ ব্যবহার করেছে, তা সেই অস্থায়ী শিবিরগুলোর ক্ষেত্রেও ব্যবহূত হতো।

দরবার হলকে (এখন দিওয়ান-ই আম নামে পরিচিত) অনেক ক্ষেত্রে বলা হয়েছে বারগাহ-ই আম (নাগরিক জমায়েতের জন্য বড় তাঁবু), সম্রাটের ঘুমানো কিংবা বিশ্রামকক্ষকে (খোয়াবগাহ) বলা হয়েছে খিলভাত কাদা-ই খাস (ব্যক্তিগত তাঁবু), হারেমকে বলা হয়েছে (নারীদের আবাস) সারপর্দা, সারপর্দা-ই ইসমত (সম্মান বজায় রাখার জন্য পর্দা ঘেরা এলাকা) বা শাবিস্তান-ই ইকবাল (সৌভাগ্যবতীর শয়নঘর বা হারেম)। অস্থায়ী শিবিরে থাকার অন্যান্য ধরনের তাঁবুর নাম এভাবে ব্যবহূত হয়েছে।

মোগল রাজকীয় শিবিরের পরিকল্পনার বিবরণ দিতে গিয়ে আবুল ফজল লিখেছেন: তারা শাবিস্তান-ই ইকবাল, দৌলতখানা (রাজকীয় প্রাসাদ বা কোয়ার্টার) ও নাকারখানাকে (ঢোল বাজানোর ঘর) রাখত ১ হাজার ৫৩০ গজের মধ্যে। এগুলোর ডান ও বাম এবং পেছনে ৩০০ গজ খোলা জায়গা থাকত রক্ষীদের জন্য। মূল পরিবেষ্টনের মধ্যে কেন্দ্র থেকে ১০০ গজ দূরে স্থাপন করা হতো মরিয়ম মাকানি (আকবরের মা), গুলবদন বেগম (আকবরের বোন) ও অন্য অভিজাত নারীদের তাঁবু; ডানদিকে স্থাপিত তাঁবুর মধ্যে থাকত শাহজাদা সুলতান সালিম ও বাঁয়ে শাহ মুরাদের। তাঁবুর পেছনে কিছুটা দূরত্বে স্থাপিত হতো বুয়োতাত (কারখানা), আরো ৩০ গজ পেছনে শিবিরের চার কোনায় বসত বাজার। রাজকীয় ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট করা চত্বরের বাইরে অভিজাতরা শিবিরের বিভিন্ন জায়গায় তাদের পদ-পদবি অনুসারে তাঁবু ফেলতেন।

এ পরিকল্পনা অনুসারে কেন্দ্রীয় এলাকাটি বরাদ্দ থাকত রাজকীয় ব্যবহারের জন্য। এর সীমান্তে থাকত শাহজাদাদের আবাস এবং সেগুলো ঘিরে থাকত অভিজাতদের তাঁবু। এ অঞ্চলের বাইরে থাকত বিভিন্ন সেবার স্থাপনা। কোনায় থাকত বাজার। এছাড়া গণ কিংবা ব্যক্তিগত পরিসর যেখানেই হোক না কেন থাকত মর্যাদা অনুসারে বিন্যাস।

সতীশ দাভর প্রথম নির্দেশ করেছেন যে, টপোগ্রাফি যেমনই হোক না কেন মোগলরা তাদের স্থায়ী প্রাসাদ ও সংলগ্ন এলাকা সেই অস্থায়ী শিবিরের নকশাতেই গড়ে তোলার প্রবণতা দেখিয়েছেন, ব্যাপারটা অনেকটা পাথরের স্থায়ী শিবির গড়ে তোলার মতো। রিজভীও মনে করেন ফতেহপুর সিক্রি ও মোগল শিবিরের পরিকল্পনার মধ্যে সাদৃশ্য আছে। এ অনুমানের ওপর ভিত্তি করেই তিনি মূল প্রাসাদের আশপাশে শাহজাদা ও অভিজাতদের বাড়িগুলো খুঁজতে চেষ্টা করেন।

আমরা যদি আবুল ফজল বর্ণিত রাজকীয় শিবিরের গঠনের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে বেশি কিছু সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া সম্ভব।

চলতি পথে সম্রাট থাকতেন পূর্বদিকে একটি বহনযোগ্য দ্বিতল প্যাভিলিয়নে (কাখ-ই দু আশিয়ানা), এটিকে ঘিরে থাকত কাপড়ে ঢাকা কাঠের দেয়াল, যার নাম ছিল গুলালবার। একই পরিবেষ্টনের মধ্যে দু আশিয়ানার সঙ্গে থাকত একটি কাঠের স্থাপনা ছোবিন রাভাতি। দু আশিয়ানাতে ঝরোখা থাকত, যা একই সঙ্গে সম্রাটের প্রার্থনার ঘর হিসেবেও ব্যবহূত হতো। এর সামনে অভিজাতরা সম্রাটকে কুর্নিশ জানাতেন। দৌলতখানা-ই খাস (সম্রাটের ব্যক্তিগত এলাকা) এবং নারীদের কোয়ার্টারের মধ্যে মাহতাবি নামে একটা ফাঁকা অংশ থাকত।

মাহতাবির মাঝখানে থাকত একটি প্লাটফর্ম (সুফফা), এটির ওপর থাকত চারটি স্তম্ভের মাধ্যমে তৈরি করা নামগিরাহ (শামিয়ানা)। সন্ধ্যাবেলা সম্রাট এখানেই বসতেন। সারপর্দা-ই ইসমত বা নারীদের নির্দিষ্ট পরিবেষ্টনের মধ্যে ২৪টি কাঠের রাভাতি থাকত। এর সঙ্গে থাকত ৬০ গজ আয়তনের আরেকটি পরিবেষ্টন, যেখানে থাকতেন উর্দুবেগিস বা সশস্ত্র নারীরক্ষী ও অন্য নারী চাকররা।

আরেকটি পরিবেষ্টনে থাকত বারগাহ বা দরবার, যেখানে ৭২টি কক্ষ থাকত এবং প্রবেশপথ থাকত দুটি। শাবিস্তান-ই ইকবাল (নারীদের জন্য সংরক্ষিত পরিবেষ্টন), বারগাহ ও দৌলতখানার বাইরে থাকত একটি পরিবষ্টন, যা দিওয়ানখানা-ই খান হিসেবে ব্যবহূত হতো যার একটু দূরে আবার থাকত আকাশদিয়া (বাতি লাগানো স্তম্ভ)।

কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে, ফতেহপুর সিক্রির দৌলতখানার পূর্বদিকের দ্বিতল ভবনটি নিঃসন্দেহে খোয়াবগা, যেখানে সম্রাট ঘুমাতেন এবং ভোরে ঝরোখা দর্শন দিতেন। এ পরিবেষ্টনের মধ্যেই খোয়াবগা থেকে একটু দূরেই আছে প্লাটফর্মের ওপর একটি স্থাপনা যেটিকে আকবরনামায় উল্লেখ করা হয়েছে পানির ট্যাংক হিসেবে।

হারামসার ও দৌলতখানার মধ্যে চারতলা একটি স্থাপনা আছে, যার মাথায় চারটি স্তম্ভের ওপর ছাতার মতো একটি গম্বুজ আছে, এ স্থাপনা ‘পঞ্চমহল’ নামে পরিচিত।

এ প্রস্তর স্থাপত্য ও শিবিরের মধ্যে বিভিন্ন সাদৃশ্য চোখ এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। সারপর্দা-ই ইসমত বা শাবিস্তান-ই ইকবালের মতো ফতেহপুর সিক্রির হারেম সার এলাকায় মূল ভবনগুলো পরে আয়তাকার পরিবেষ্টন ছিল, যা সম্ভবত নারীরক্ষীদের আবাস হিসেবে ব্যবহূত হতো।

আবুল ফজল উল্লেখ না করলেও দেখা যায় যে, তৈমুরীয় ঐতিহ্যে রাজকীয় শিবির স্থাপিত হতো উত্তর-দক্ষিণ অক্ষ বরাবর। দ্বিতীয়ত, মোঙ্গল ঐতিহ্যে ছিল বাঁ থেকে ডানে পদক্রম, যা দক্ষিণ দিকে এগোত—অর্থাৎ দক্ষিণ থাকত ডান দিকে। ফলে সম্রাট যেন দক্ষিণ দিকে মুখ করে বসতে পারেন। এ দুই রীতির প্রয়োগ ফতেহপুর সিক্রিতে পাওয়া যায়। ঝরোখা জানালায় বসলে আকবর দক্ষিণ দিকে মুখ করে থাকতেন, তার পেছনে উত্তর দিকে থাকত দৌলতখানা।

আরো উত্তরে পাওয়া যেত নাকারখানা ও আকাশদিয়া, হিরণ মিনার। আকবরের ডানে থাকত সালিম চিশতীর সমাধি, জামে মসজিদ ও ইবাদতখানা। অ্যালিনা ম্যাকনিল মনে করেন, ফতেহপুর সিক্রি তৈমুরীয় শিবির স্থাপনের পরিকল্পনা অনুসরণে নির্মিত, তবে টপোগ্রাফির কারণে এর একক উত্তর-দক্ষিণ অক্ষটি দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে; একটি গণপরিসর থেকে ব্যক্তিগত অঞ্চলে অন্যটি রাজকীয় হাজিরার অক্ষ। ক্রম অগ্রসরমাণ অক্ষটি উত্তর-পূর্ব থেকে উত্তর-দক্ষিণে, এ অক্ষে ছিল দিওয়ান-ই আম, দৌলতখানা ও হারেমসার। মোগল শিবিরের মতো ফতেহপুরেও ছিল প্যাভিলিয়ন ও পরিবেষ্টন। বড় পরিসরের জায়গায় থাকত প্যাভিলিয়ন।

আমরা দেখি যে, শিবিরে প্রাসাদগুলো ঘিরে থাকত আমলাতান্ত্রিক স্থাপনা, অভিজাতদের বাড়ি ও সাধারণ মানুষের বসতির বৃত্ত। আর বাজারগুলো প্রান্তে সরলরৈখিক অবস্থানে থাকত।

ফতেহপুর সিক্রির নকশার আরেকটি সম্ভাব্য উৎস হতে পারে মোগল-বাগান, চাহারবাগ। পেট্রুসিওলির মতে, চাহারবাগের কেন্দ্রমুখী প্রতিসাম্য মোগল নগর পরিকল্পনার অনুপ্রেরণা হতে পারে। বাগানের অক্ষ, সংযোগ কিংবা অর্বুদ স্থাপত্যরীতিতে গিয়ে প্যাভিলিয়ন, চাবুতারাস, ঝর্ণা, জলাশয়, ক্যারাভান সরাই ও গোছানো রাস্তায় পরিণত হয়েছে। এভাবে মডিউলার গ্রিড পদ্ধতিগত নকশা উপাদানে পরিণত হয়েছে। শহর বিভক্ত হয়েছে বিভিন্ন ভাগে, যার কেন্দ্রে ছিল মূল স্থাপনা এবং এ কেন্দ্রের সঙ্গে প্রতিসাম্যে সারিবদ্ধ হয়েছে অন্য স্থাপনাগুলো।

বিচ্ছিন্নভাবে নির্দিষ্ট কোনো স্থাপনা কিংবা ভবনের প্রেরণা এসেছে অনেকগুলো ঐতিহ্য থেকে। ফতেহপুর সিক্রির নির্মাণকাজ যখন শুরু হয়, ততদিনে প্রাক-মোগল মুসলিম শাসকদের স্থাপত্যে রাজপুত ও গুজরাটি স্থাপত্যরীতির আত্মীকরণ হয়ে গেছে। ফতেহপুর সিক্রিতে মুখ্য প্রভাব দেখা যায় তৈমুরীয় ও গুজরাটি স্থাপত্যরীতির। সিক্রির অনেক স্থাপনায় ধনুকের মতো বাঁকানো (‘সারাসিন’ বা দিল্লি সালতানাতের রীতি), সঙ্গে ট্রাবিয়েট রীতি (গুজরাটি সালতানাতের আকর্ষণীয় রীতি) দেখা যায়। খোয়াবগা, দিওয়ান-ই আমে সম্রাটের আসন, দপ্তরখানা, তানসেন বরদারি, টোডরমলের বরদারি, হারা মহল, কুশখানা এবং শহরের ফটকগুলোতে এ রকম উদাহরণ দেখা যায়। খিলানগুলোতে পরস্পরকে ছেদ করে যাওয়া চারটি বড় শিরা দেখা যায়, যা আবার একটি কেন্দ্রীয় খিলানযুক্ত অংশ তৈরি করে।

হাম্মামে পাওয়া যায় আয়তাকার নকশা, এর সাধারণ একটি নমুনা হাকিমের গোসলখানা বা রাজকীয় হাম্মাম। অন্য হাম্মাম, ক্যারাভানসরাই ও প্রাসাদ ভবনের উপরে প্যাভিলিয়নগুলোতে মধ্য এশীয় স্থাপত্যরীতির ব্যবহার দেখা যায়। রঙ মহল ও সংলগ্ন কমপ্লেক্স (পেট্রুসিওলির বড়ি মহল), চারতলা প্যাভিলিয়ন যা ‘পঞ্চ মহল’ নামে পরিচিত, হাওয়া মহল নির্মিত হয়েছে ইরানীয় ও তৈমুরীয় পোস্ট অ্যান্ড বিম পর্চেসের ভিত্তিতে। ইরানে এ রকম স্থাপনা ‘তালার’ নামে এবং ট্রান্স-অক্সিয়ানা অঞ্চলে আইওয়ান নামে পরিচিত।

এসব স্থাপনার ট্রাবিয়েট নির্মাণের ক্ষেত্রে মাপজোখের নিখুঁত ব্যবহার দেখা যায়। ভারী হওয়ার যে সমস্যা সারখেজে মাহমুদ বেগরার প্রাসাদ ও খিমলাসা দুর্গের নাগিন মহলে (পঞ্চদশ শতাব্দী) দেখা দিয়েছিল, সেটা এখানে কাটিয়ে ওঠা যায়। আকবরের স্থাপত্যের গৌরব ছিল জ্যামিতিক নির্ভুলতা। বিরবলের প্রাসাদ, বুলান্দ দরওয়াজা ও হাতিপোলে দেখা যায় সমান অনুপাতে আরকুয়েক ও ট্রাবিয়েট রীতির ব্যবহার। দেখা যায় কাঠের স্থাপত্যের ব্যবহারও—হাজরা-ই অনুপতালাও (তুর্কি সুলতানের ঘর) ও চাহারখানা (আঁখমিচৌলি), রঙ মহল ও বড়ি মহলের স্তম্ভ আমাদের কাঠের স্থাপত্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

 

সৈয়দ আলী নাদিম রেজাভি: অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি ও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত Fathpur Sikri Revisited (2013) গ্রন্থের লেখক।

*প্রবন্ধটি লেখকের অনুমতিক্রমে ঈষৎ সংক্ষেপিত রূপে বাংলায় ভাষান্তর করা হয়েছে


শর্টলিংকঃ