বিনা টাকায় পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি পেল ওরা


নিজস্ব প্রতিবেদক, নাটোর:

পুলিশের কনস্টেবল পদে আগে থেকেই বিনা টাকায় নিয়োগ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন নাটোরের পুলিশ সুপার সাইফুল্লাহ আল মামুন। মাত্র এক’শ টাকার
বিনিময়ে চাকুরী পাওয়া যাবে পুলিশের এমন ঘোষণার পর অনেকেই বিষয়টি হাস্যকর বলেছেন। কিন্তু বিনা টাকায় চাকুরী দিয়ে সে কথা রেখেছেন পুলিশ সুপার
সাইফুল্লাহ আল মামুন। বিনা টাকায় চাকুরী পেয়ে এখন হত দরিদ্র পরিবারগুলোতে চলছে আনন্দের বন্যা।

বিনা টাকায় পুলিশের চাকুরী পেয়েছে এমন কয়েকটি হত দরিদ্র পরিবারকে খুঁজে বের করা হয়েছে। যারা চাকুরী পেয়েছেন তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া আদ্য-প্রান্ত
তুলে ধরা হল পাঠকদের জন্য।

বিনা টাকায় চাকুরী হয়, এটা কোন মানুষই বিশ্বাস করে না। তাও আবার পুলিশের চাকুরী। কখনও এটা বিশ্বাস হচ্ছিলো না, যে বিনা টাকায় আমার চাকুরী হবে। পুলিশের সার্কুলার দেওয়ার পর আবেদন করার টাকাও ছিল না আমার কাছে। বড় দুলাভাই দুই’শ টাকা দেওয়ার পর সে টাকা দিয়েই আবেদন করি। যে দিন লাইনে
দাঁড়াবো, সে দিন মায়ের অন্যের বাড়িতে কাজ করে আনা দুই’শ টাকা নিয়ে যাই।

এখন চাকুরীটা পাওয়ার পর পরিবারের সবার মুখে হাসি ফুটেছে। হত দরিদ্র পরিবারের মেয়ে হিসেবে চাকুরীটা পাওয়া মানে আমার কাছে পৃথিবী হাতের মুঠোয়  পাওয়ার মতো ঘটনা। চোখে আনন্দ অশ্রু আর শত কষ্ট ছাপিয়ে এভাবেই পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকুরী পাওয়ার বর্ণনা দিচ্ছিলেন, নাটোরের সিংড়া উপজেলার পাকুরিয়া গ্রামের হত দরিদ্র জবদুল প্রামাণিকের মেয়ে সাদিয়া সুলতানা।

সিংড়ার প্রত্যন্ত এলাকা পাকুরিয়া গ্রাম। গ্রামের এই মাটির ঘরেই বেড়ে উঠা সাদিয়া সুলতানার। সাদিয়ার বাবার দুই স্ত্রী। প্রথম স্ত্রীর ঘরে সাদিয়ার মা সহ ৫জনের বসবাস। সাদিয়ার বাবা দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় বসবাস করেন। তেমন একটা খোঁজ রাখেন না তাদের। মা হাজেরা বেগম অন্যের বাড়িতে কাজ
করে তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। অন্যের বাড়িতে কাজ করে যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার আর সাদিয়ার পড়াশুনার খরচ বহন করেন। বর্তমানে সাদিয়া চলনবিল মহিলা ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। চার বোনের মধ্যে সাদিয়া সবার ছোট।

সাদিয়া সুলতানার মা হাজেরা বেগম বলেন, প্রথমে যখন পুলিশ নিয়োগের সার্কুলার হয়, তখন আমার বড় মেয়ে জামাই ইসমাইল হোসেন ফোনে সাদিয়াকে আবেদন
করতে বলেন। সাদিয়া তখন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে আবেদন করতে চায় না। তার দুলা ভাইকে বলে টাকা ছাড়া চাকুরী হবে না, শুধু শুধু আবেদন করে কি লাভ। তারপরও দুলাভাইয়ের কথা অনুযায়ী সাদিয়া জামাইয়ের কাছ থেকে দুই’শ টাকা নিয়ে আবেদন করে। পরে লাইনে দাঁড়ালে তার চাকুরীটা হয়। এখন বিশ্বাসই হচ্ছে না
টাকা ছাড়াও সরকারী চাকুরী হয়।

নাটোর শহরতলীর দিঘাপতিয়া ইউনিয়নের বেজপাড়ার দিনমুজুর আমিরুল ইসলামের ছেলে রাসেল আলী। দিনমুজুর আমিরুল ইসলাম অন্যের মিলে কাজ করে যা আয় হয়, তা দিয়েই সংসার চালান। আর ছেলে রাসেল আলী প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের পড়া-শুনার খরচ চালাতেন। এবারের রিক্রুটে বিনা টাকায় চাকুরী হয়েছে তার। এখন পরিবারে চলছে আনন্দের বন্যা। বর্তমানে এনএস সরকারী কলেজে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাসেল আলী।

রাসেল আলী বলেন, চাকুরী মানের ৭/৮ লাখ টাকার ব্যাপার। কিন্তু আমার পরিবারের পক্ষে এত টাকা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। বাবা একাই দিনমুজুরি করে
সংস্কার চালান। সেখানে ৭/৮লাখ টাকা কোথায় পাবো। একদিন পত্রিকায় কনস্টেবল পদে সার্কুলার দেখে নিজেই ১০৩টাকার বিনিময়ে আবেদন করি। পরে সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি। বিনা টাকায় চাকুরী পাবো, কখনও কল্পনাতেও ছিল না।

রাসেল আলীর মা রানু বেগম বলেন, যে দিন ছেলে লাইনে দাঁড়াবে, সে দিন তার হাতে এক’শ টাকাও তুলে দিতে পারিনি। বিশ্বাসই হচ্ছে না টাকা ছাড়া আমার ছেলের চাকুরী হবে। এখন ছেলের চাকুরীটা পাওয়ার কারণে আমরা আশায় বুক বাঁধছি।

নাটোরের উত্তরা গণভবনের পিছনে জেলে পাড়া। এই জেলে পল্লীর দীনেশ হালদারের ছেলে দিপন কুমার হালদার। দীনেশ হারদার মাছ ব্যবসা করে সংসার চালান তিনি। রাস্তার পাশের টিনের আধা পাকা বাড়িতেই দিপন কুমারের বসবাস। দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় সে। বর্তমানে এমকে কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশুনা করছেন।এবারের পুলিশ নিয়োগে বিনা টাকায় অন্যদের মতো তারও চাকুরী হয়েছে। ছেলের চাকুরী পাওয়া কারণে যেন গরিবের ঘরে হাতির পাড়া এমন অবস্থায় দিপনের পরিবারে।

শুধু সাদিয়া, রাসেল আলী বা দিনেশ হালদার নয়। এবারের পুলিশ রিক্রুটে বিনা টাকায় চাকুরী হয়েছে অনেকে। এদের মধ্যে বাগাতিপাড়া উপজেলার ডুমরাই ঢাকা পাড়া গ্রামের জাফর আলীর মেয়ে লিজা খাতুন, সদর উপজেলার মির্জাপুর গ্রামের বাছেদ শেখ এর মেয়ে রুনা খাতুন, মোহনপুর এলাকার দিনমুজুর আব্দুস সামাদের ছেলে রাজেকুল ইসলাম এবং লালপুর উপজেলার বিলমাড়িয়া নাগষোশা গ্রামের আমিরুল ইসলামের ছেলে শিমুল ইসলামের চাকুরী হয়েছে বিনা টাকায়। এসব পরিবারে এখন চলছে আনন্দের বন্যা।

উল্লেখ্য, গত ২২জুন নাটোর পুলিশ লাইন্স মাঠে বাংলাদেশ পুলিশের ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে নাটোর জেলার নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
উক্ত নিয়োগ পরীক্ষায় পুরুষ পদে ২৩ জন, নারী পুলিশ সদস্য পদে ৪ জন, বিশেষ কোটায় অপূরণ কৃত পদে পুরুষ ২৪ জন, নারী পুলিশ সদস্য পদে ১৮ জন সহ সর্বমোট ৬৯ জন পুলিশ সদস্য নিয়োগ করা হয়।

 


শর্টলিংকঃ