মতিহারজুড়ে স্থাপনায় সমুজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধ


মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধরে রাখতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ক্যাম্পাসজুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা। যার মধ্যে সাবাস বাংলাদেশ, শহীদ মিনার, বধ্যভূমি, শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা, শহীদ বুদ্ধিজীবী চত্বর, বিদ্যার্ঘ,স্ফুলিঙ্গ অন্যতম। মহান স্বাধীনতা দিবসে স্থাপনাগুলোর খুঁটিনাটি নিয়ে লিখেছেন হোসাইন মোহাম্মদ সাজ্জাদ ও সুব্রত গাইন।

সাবাস বাংলাদেশ:

কবি সুকান্তের অগ্নিঝরা কবিতার চরণ খচিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার তেজস্বী প্রকাশ এবং নান্দনিকতার অনবদ্য স্মারক ‘সাবাস বাংলাদেশ’ ভাস্কর্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকলেই চোখে পড়ে সবুজের বুক-চিরে নির্মিত ভাস্কর্যটি।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ শিক্ষক-ছাত্রদের স্মৃতিকে চির অম্লান রাখার উদ্দেশ্য নিয়ে এই ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়। সিনেট ভবনের দক্ষিণে ১৯৯১ সালের ৩ ফেব্রæয়ারি রাকসুর উদ্যোগে শিল্পী নিতুন কুন্ডুর নকশায় নির্মাণ কাজ শুরু হয়। নির্মাণ শেষে ভাস্কর্যটি ফলক উন্মোচন করেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।

শহীদ মিনার:

বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারটি দেশের অন্যান্য শহীদ মিনারের গড়নের থেকে ভিন্ন। এটির নকশা করেন স্থপতি খায়রুল এনাম। ১৯৭২ সালের ৯ মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই শহীদ মিনারের ভিত্তি স্থাপন করেন। এতে রয়েছে চারটি বাহু।

যেগুলোর উপরের দিকে বান্ধনী দ্বারা আবদ্ধ। চারটি বাহু দ্বারা ১৯৭২ সালের সংবিধানের চারটি মূলনীতি- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে ইঙ্গিত করা হয়েচে। এ শহীদ মিনারের অবিচ্ছেদ্য অংশ ম্যূরাল চিত্র, শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা, উন্মুক্ত মঞ্চ, সুবিস্তৃত খোলা প্রান্তর ও ফুলের বাগান।

এটি কৃত্রিমভাবে তৈরি মাটির ঢিলার উপর অবস্থিত। অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় মিনারের ভিত্তি মূলে। মিনারের পশ্চাতে রয়েছে দীর্ঘ একটি ম্যূরাল চিত্র। চিত্রটিতে রুপ দেয়া হয়েছে একজন স্নেহময়ী মা ও তাঁর বীর সন্তানদের অবয়ব। শহীদ মিনারের পটভ‚মিতে রয়েছে বিখ্যাত শিল্পী মুর্তজা বশীর নির্মিত দুটি ম্যুরাল।

শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা ও মুক্তমঞ্চ:

শহীদ মিনারের পাদদেশের পূর্বদিক থেকে উদিত হয় নতুন দিনের সূর্য, সেদিকে অবস্থিত শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা। সংগ্রহশালাটির ডিজাইন করেছেন স্থপতি মাহবুবুল হক। দেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. শামসুজ্জোহাসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের পোশাক, মাথার খুলি এবং মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন উপকরণ সংরক্ষণ করা রয়েছে রাবির শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালায়।

এখানে ১৯৫২, ‘৬৬, ‘৬৯, ‘৭১ সালের আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত সংগৃহীত নিদর্শনগুলো পর্যায়ক্রমে প্রদর্শিত আছে। এটি দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক স্বয়ংসম্পূর্ণ জাদুঘর।

সংগ্রহশালার পাশ ঘেঁষে রয়েছে একটি উন্মুক্ত মঞ্চ। পিছনের দেয়ালে রয়েছে গ্রামবাংলার আবহমান দৃশ্য যা রিলিফ ওয়ার্কে নানা রঙের মাধ্যমে রূপ দেয়া হয়েছে। এটি নির্মাণ করেন শিল্পী ফণীন্দ্রনাথ রায়। এ মঞ্চে মঞ্চস্থ হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিঁকি ভাগ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। যার মাধ্যমে ছড়িয়ে যায় বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণের ধারা।

শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক:

২০১৬ সালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ রাবির চার শিক্ষকের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক নির্মাণের উদ্যোগ নেয় তৎকালীন প্রশাসন। চারুকলা অনুষদের শিক্ষকদের নকশায় প্রায় ৬১ লাখ টাকা ব্যয়ে স্মৃতিফলকটি নির্মাণ শুরু হয়।

এটির বেদির আয়তন ১ হাজার ৭৪০ বর্গফুট। বেদির তিন দিকে ফেন্সি ব্রিক দিয়ে নির্মিত হয়েছে সিঁড়ি। মূল বেদির দক্ষিণ ধারে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধা জানাতে নির্মিত হয়েছে ২৬ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ৭ ফুট প্রস্থের কালো মার্বেল পাথরের বেদি।

তার উপরে ২৪ ফুট দৈর্ঘ্য ও তিন ফুটের প্রস্থে সবুজ বেদি। তার উপরে ১০ ফুট উচ্চতা ও ২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে দেয়াল। সাদা এ দেয়ালের পেছনের অংশে খোদাই করা হয়েছে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, শহীদ জোহার স্মৃতি এবং ৭০’র নির্বাচনের বিভিন্ন খন্ড চিত্র।

সামনের দেয়ালে বাম পাশে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ রাবি শিক্ষক সুখরঞ্জন সমাদ্দার, হবিবুর রহমান, মীর আব্দুল কাইয়ুমের প্রতিকৃতি। ডান পাশে নীচে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের দৃশ্য।

বর্বরতার সাক্ষী বধ্যভূমি:

মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার স্বাক্ষী বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলে ক্যাম্প গড়ে তোলে হানাদার বাহিনী।

রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন অভিযান চালিয়ে নিরপরাধ মানুষদের ধরে আনা হতো এখানে। নির্বিচারে হত্যা করা হতো। কাউকে গুলি করে, কাউকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বা জবাই করে হত্যা নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।

তথ্যমতে, সেসময় জোহা হল পূর্ণাঙ্গভাবে নির্মাণের জন্য প্রচুর ইট এনে রাখা হয়েছিল, হলের পাশেই গর্তের মতো জায়গায়। পাকিস্তানি বাহিনী মানুষ হত্যা করে ওই গর্তের মধ্যে ফেলে রাখতো। কখনও কখনও নির্মমভাবে হত্যার পর শহীদদের মরদেহ গণকবর দিয়ে রাখা হতো।

দেশ স্বাধীনের পর ওই বধ্যভূমি থেকে বহু মানুষের হাড়গোড় উদ্ধার করা হয়। সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা সংরক্ষণ করা হয়। সেখানে পরে বধ্যভূমি নির্মাণ করা হয়। ২০০২ সালের ২১ ডিসেম্বর স্তম্ভটির উদ্বোধন করা হয়।

বধ্যভূমির পাশেই এখন একটি বটগাছ বেড়ে উঠছে। চারদিকে সুনসান। তবে চারজন পুলিশ সদস্য পাহারায় থাকেন। স্মৃতিস্তম্ভের দুই পাশে বটলব্রাশের সারি। ফুলের বাগানে সালভিয়া, করবী, পপি, ফায়ারবল, গাঁদা ও নয়নতারা।

আজ যাঁরা এই সৌম্য স্মৃতিস্তম্ভের সামনে এসে দাঁড়ান, তাঁদের পক্ষে কল্পনাও করা সম্ভব নয়, একাত্তরে কী বীভৎস দৃশ্যের সূচনা হয়েছিল এখানে। তবে যাঁরা প্রাণে বেঁচে ফিরে এসেছেন, আর যাঁরা স্বজনদের খুঁজতে গিয়ে লাশের স্তূপ হাতড়ে বেরিয়েছেন, তাঁদের স্মৃতিতে ওই দুঃস্বপ্নের দৃশ্য আজও জ্বলজ্বল করে।

স্ফুলিঙ্গ :

১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় ১৮ ফেব্রæয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করার চেষ্টা করেন। আন্দোলনকারী ছাত্ররা মিছিল বের করলে অনেক ছাত্রের জীবননাশের আশঙ্কা থাকায় সেনাসদস্যদের নিজের পরিচয় দিয়ে তৎকালীন প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা ছাত্রদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে নিষেধ করেন।

পাকিস্তানি বাহিনী ও বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের মাঝে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘ডোন্ট ফায়ার! আই সেইড ডোন্ট ফায়ার! কোনো ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে আমার বুকে গুলি লাগবে।’

সত্যিই সেদিন ছাত্রদের গায়ে গুলি লাগার আগে ড. জোহার বুকে গুলি চালায় পাকিস্তানি সেনারা। তাঁর আত্মত্যাগের পরপরই তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ড. জোহার নামানুসারে নবনির্মিত আবাসিক হলের নামকরণ করেন শহীদ শামসুজ্জোহা হল।

২০১২ সালে হলটির মূল ফটকের পাশে ড. শামসুজ্জোহার স্মৃতিস্মারক ভাস্কর্য স্ফুলিঙ্গ নির্মাণ করা হয়। এটির উচ্চতা ১৫ ফুট, দৈর্ঘ্য ৩৮ ফুট এবং ২৪ ফুট প্রস্থবিশিষ্ট্য। এছাড়া ২০১৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রশাসনিক ভবনে ড. জোহার সমাধিস্থল ঘিরে ‘জোহা চত্ত¡র’ নির্মাণ করা হয়। সদর আসনের সংসদ সদস্য এ চত্ত¡র নির্মাণে ১ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ দেন।

বিদ্যার্ঘ ভাস্কর্য :

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে হানাদার বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে আক্রান্ত হয়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও। ১৩ এপ্রিল জোহা হলে ঘাঁটি গেড়ে বসে পাকিস্তানি বাহিনী। ১৫ এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্যরা গণিত বিভাগের অধ্যাপক হবিবুর রহমানের বাসায় অভিযান চালায়। তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরী ভবনে হত্যা করা হয়।

শহীদ হবিবুর রহমানের সর্বোচ্চ ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর নামে নির্মাণ করা হয় শহীদ হবিবুর রহমান হল। বর্তমান প্রজন্মের কাছে তাঁর ত্যাগ ও স্মৃতি স্মরণীয় করে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শহীদ হবিবুর রহমান হলে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করে। এ ভাস্কর্যটির নাম ‘বিদ্যার্ঘ’। ২০১১ সালের ২৬ মার্চ ভাস্কর্যটি উন্মোচন করা হয়। ভাস্কর্যটির স্থপতি শাওন সগীর সাগর।

এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বল ইতিহাসকে স্মরণীয় করে রাখতে ২০০৩ সালে নির্মাণ করা হয় ‘গোল্ডেন জুবেলী টাওয়ার’। প্রধান ফটক পেরিয়ে সড়ক দ্বীপের ডানে, প্রশাসনিক ভবনের সামনের গোল চত্বরের দক্ষিণ-প‚র্বে অবস্থিত। এর স্থপতি মৃণাল হক। টাওয়ারের সঙ্গে লাগানো ইস্পাতের একটি দেয়াল আছে। দেয়ালটির নাম ইস্পাতের কান্না।

সেই দেয়ালে মালবাহী ভ্যান, ঘোড়ার গাড়ি, মানুষ, সাইকেল, সূর্যমুখী ফুল এবং শহীদ মিনারের কারুকাজ করা আছে। কারুকাজগুলো শিকল দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। আর শিক্ষার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বিকাশকে ত্বরান্বিত করতে নির্মাণ করা হয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তন।


শর্টলিংকঃ