মাদকবিরোধী প্রচারণার নামে স্কুলে স্কুলে টাকা আদায়!


তারেক রহমান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ:

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের কাছে জোর করে ১০ টাকা মূল্যের মাদকবিরোধী স্টিকার বিক্রি করছে বেসরকারি একটি সংস্থা। ওই স্টিকারে বেশ কয়েকটি মাদকদ্রব্যের বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। যা সম্পর্কে ধারণায় নেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর।

চাঁপাইয়ে স্কুলে স্কুলে বিক্রি করা মাদকের স্টিকার। ছবি: সংগৃহিত

সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই না করেই ‘ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি এলকোহল এবং প্রতিভা এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’কে এমন কর্মকান্ড চালানোর অনুমোদন দিয়েছে খোদ সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর।

অভিভাবক ও শিক্ষকদের শঙ্কা- ‘কথিত মাদকবিরোধী এই স্টিকারের মাধ্যমেই স্কুলের শিক্ষার্থীদের মাঝে মাদকের বিস্তার ঘটার ব্যাপক সুযোগ তৈরি হচ্ছে।’

সচেতন শিক্ষক ও অভিভাবকরা বলছেন- গ্রামের অনেক শিক্ষার্থীরা যেখানে ১০ টাকা পরীক্ষার ফিস পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে নামমাত্র মূল্যের কথা বলে ১০টায় স্টিকার বিক্রি করা হচ্ছে। অপরিকল্পিত এই মাদকবিরোধী প্রচারণার নামে বেসকরারি প্রতিষ্ঠানের মালিক প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।

তবে বেসরকারি ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক ডা. আনোয়ার হোসেনের দাবি- মাদকবিরোধী কর্মকান্ড চালাতে গিয়ে তিনি অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাই সরকার তাকে প্রচারণা চালানোর জন্য নামেমাত্র (!) ১০ টাকা মূল্যে স্টিকার বিক্রির অনুমতি দিয়েছে।
শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জে নয়, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লাতেও জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় তিনি এমন কর্মকান্ড চালাচ্ছেন বলেও জানান তিনি।

ডা. আনোয়ার এই প্রতিবেদককে মোবাইলে তার অফিসে চায়ের দাওয়াত দিয়ে বলেন, ‘আপনারা সহযোগিতা করুন। আমি মাদক নির্মুলে ব্যাপক কাজ করবো।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৌশলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের অনুমোদন নিয়ে চলতি বছরের ২ এপ্রিল থেকে শিবগঞ্জ উপজেলার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে হিসেব করে শিক্ষার্থী প্রতি একটি করে স্টিকার ও লিফলেট পাঠানো হয়।

উপজেলা শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য ৪৮ হাজার ৫৬৩টি ও নি¤œ মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও মাদ্রাসার জন্য ৬২ হাজার ৩৯৬টি স্টিকার পাঠানো হয়েছে।

যার মূল্য রাখা হচ্ছে ১০ টাকা। অর্থাৎ শুধুমাত্র শিবগঞ্জ উপজেলাতে স্টিকার বিক্রি করে বেসরকারি ওই প্রতিষ্ঠানের আয় হবে প্রায় ১১ লাখ ১০ হাজার টাকা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৭ সালে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাদকবিরোধী কর্মসূচি আয়োজনের জন্য নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করে ‘ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি এলকোহল এবং প্রতিভা এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’র কো-অর্ডিনেটর ডা. আনোয়ার হোসেন।

তার আবেদনের প্রেক্ষিতে অধিদপ্তরের অতিরিক্ত সচিব (পলিসি ও অপারেশন) সঞ্জয় কুমার চৌধুরী স্বাক্ষরিত একটি পত্রে আবেদনকারীকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দিতে পুলিশের আইজিপিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১০টি বিভাগকে চিঠি দেয়া হয়।

পরে ২০১৮ সালের ২৬ জুলাই চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারকে নির্দেশ দেন রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের তৎকালীন উপ-পরিচালক। ওই চিঠির প্রেক্ষিতে ২৩ সেপ্টেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শিক্ষা অফিসার আবদুল কাদের এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সকল উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার নির্দেশ দেন।

পরে চলতি বছরের ৩১ মার্চ মানবিক কারণে মাদকবিরোধী কর্মসূচির অংশ হিসেবে বিনামূল্যে মাদকবিরোধী লিফলেট এবং সহনীয় মূল্যে (১০ টাকা) স্টিকার প্রেরণ সংক্রান্ত চিঠি উপজেলার সকল স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা প্রধান বরাবর পাঠানো হয়। চিঠিতে মাদকাসক্ত শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপনের কথা উল্লেখ করা হয়।

উপজেলার বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সাম্প্রতি ফ্রিডম (স্টিকার বিক্রি করা সংস্থা) এর কিছু ব্যক্তি শিবগঞ্জে আসেন। তারা নিজেদেরকে রাজশাহী বিভাগীয় অফিসের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের ইউএনও অফিসে ডেকে নেন।

সেখানে ইউএনও দফতরের একজন কর্মকর্তার মাধ্যমে ৩১৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের হাতে শিক্ষার্থী প্রতি একটি স্টিকার ও লিফলেট ধরিয়ে দেন। সেগুলো বিক্রি করে আগামী ১ মে এর মধ্যে টাকা পরিশোধের নির্দেশনা দেন।

রাজনর উত্তমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তৌফিকুল ইসলাম ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে ইউনিভার্সাল২৪নিউজ.কম-কে বলেন, ‘আমার স্কুলে ১২৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। সেই হিসেবে ১২৫টি স্টিকার দেওয়া হয়েছে। ১০ টাকা করে বিক্রি করে ১ হাজার ২৫০ টাকা আগামী ১ মে এর মধ্যে পরিশোধ করতে বলেছেন স্যাররা।’

একই তথ্য জানান পৌর এলাকার মরদানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গোলাম আজম। তিনি বলেন, কিছু শিক্ষার্থী এটি কিনলেও বেশিরভাগই কিনতে চাইছে না। অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবকও স্কুলে এসে ঝামেলা করছে। স্টিকার বিক্রির জন্য হকারি করবো নাকি ক্লাসে; তা নিয়ে পড়েছি ঝামেলায় পড়েছি।

শিবগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা অফিসার এসএম মাহমুদ হাসান বলেন, ‘স্টিকার বিক্রির বিষয়ে আমি কিছু জানি না। শুনেছি- ইউএনও অফিসে বসে শিক্ষকদের কাছে এগুলো বিতরণ বা বিক্রি করা হয়েছে।’ তবে জোর করে শিক্ষার্থীদের কাছে এটি বিক্রি করা ঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার সিরাজুল ইসলামও বিষয়টি জানেন না বলে দাবি করেন।

জানতে চাইলে শিবগঞ্জ উপজেলার ইউএনও চৌধুরী রওশন ইসলাম বলেন, ‘নামেমাত্র মূল্যে বিক্রয় করার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে কোনো শিক্ষার্থীকে স্টিকার কিনতে বাধ্য করা হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জেলা প্রশাসক এ.জেড.এম নুরুল ইসলাম বলেন, ‘টাকার বিনিময়ে স্কুল কলেজে স্টিকার বিক্রির বিষয়টি আপনার কাছ থেকেই প্রথম শুনলাম। এ ব্যাপারে কিছুই জানা নেই। আমি বিষয়টি নিয়ে খোঁজ-খবর নিচ্ছি।’


শর্টলিংকঃ