মৃৎশিল্প তৈরির সরঞ্জাম আছে, নেই কারিগর!


সুব্রত গাইন: 
এই তো সেদিনের কথা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পাল পাড়ায় ঠুকঠাক হাড়ি-পাতিল বানানোর শব্দ শোনা যেতো। মাটির তৈরি জিনিসে পুরো উঠান ভরে যেতো। মাটির কলসি, হাড়ি-পাতিল, শড়া, পিঠা তৈরির সাজ, ঝাজর, মাটির বাসন, পুতুল, এমন অসংখ্য মাটির তৈরি তৈজসপত্র সারিবদ্ধভাবে রোদে শুকাতে দিতো। শুকানোর পর এগুলো চুল্লিতে পুড়িয়ে ব্যবহারের উপযোগী ও দর্শনীয় করে তুলতে ওই পেশায় নিয়োজিত দক্ষ পাল শ্রমিকেরা।

কিন্তু কালের বির্বতনে এখন প্রায় বিলুপ্তর পথে এই জনপ্রিয় পেশা। অধিক বিনিয়োগ আর আধুনিক যুগের অ্যালুমিনিয়াম, প্লাস্টিক ও স্টিলের তৈজসপত্রের ছড়াছড়িতে বাজারে টিকতে পারে না মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল। যার ফলে মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত কারিগররাও জীবিকার তাগিদে জড়িয়ে পড়ছেন ভিন্ন পেশায়। তবে তাদের ব্যবহারকৃত সরঞ্জামাদি এখনো অনাদরে অবিকলভাবে পড়ে আছে উঠানে। এমনকি মাটির জিনিসপত্র পোড়ানো চুল্লীর ঘর ভেঙে পড়ে মিশে গেছে মাটির সাথে।

মাদারীপুর জেলার রাজৈর থানায় এমন বেশ কয়েকটি গ্রামে পাল বংশ আছেন যারা এই ঐতিহ্যবাহী পেশা ছেড়ে দিয়ে যোগ দিয়েছেন অন্য পেশায়। তবে তাদের কাজ ব্যবহৃত সরঞ্জাম রয়ে গেছে অবিকল। অধিক বিনিয়োগ ও পরিশ্রমের ফলে কেউ আর সখের বসেও করতে চাচ্ছে না। বংশীয় পরম্পরা মেনে কেউ কেউ চালিয়ে যাচ্ছে তবে তা ভাত আনতে পান্তা ফুরানোর উপক্রম।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাদারীপুরে শিবচর, ঘটমাঝি, খালিয়া, নাগরদী, কবিরাজপুর, পান্থাপাড়াসহ বেশ কিছু এলাকায় এক সময় মৃৎশিল্পের কাজ ছিলো চোখে পড়ার মতো। একসময় রাজৈর থানার নাগরদী গ্রামে পালপাড়ায় প্রায় ২২টি পরিবার মৃৎশিল্প কাজে জড়িত ছিলো। আধুনিক যুগে এসে হাতেগোনা কয়টি পরিবার আছেন যারা এখনো পূর্বপুরুষের এই শিল্পকে আকড়ে রয়েছে। আর বাকি পরিবারগুলো আধুনিকতার প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বেঁছে নিয়েছেন অন্য পেশা।

মাটির চড়া মূল্য, মাটির তৈরি তৈজসপত্র কেনার অনীহা, বাজারে পর্যাপ্ত মূল্য, দক্ষ শ্রমিক, জ্বালানীর অভাবে থমকে আছে শিল্পটি। অনেক পরিশ্রম এবং কম মজুরি দেখে ইচ্ছাকৃতভাবে এই পেশা থেকে ছেলে-মেয়েদের অন্যপেশায় নিয়োজিত করছে বাবা-মা। আবার ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করে চাকুরির দিকে ধাপিত করছে। যার ফলে এক প্রকার বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী এই পেশাটি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজৈর থানায় নাগরদী গ্রামে ২২টি পরিবারের মধ্যে এখন মাত্র ৫টি পরিবার মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত আছে। তবে তা চোখে পড়ার মতো নয়। হাতে গোনা কয়েকজন মাটির কাজ করছেন।

মৃৎশিল্পের সাথে জড়িতদের মধ্যে ধীরেন পাল এখনও তার পূর্বপুরুষের পেশার সাথে জড়িত। তিনি এবং তার স্ত্রী এখনও রাত দিন এক করে কাজ করছেন। জানতে চাইলে ধীরেন বলেন, ‘বাপ দাদার পেশা সহজে কি ছাড়া যায়। মন চায় মাঝে মাঝে ছেড়ে দেই। কিন্তু কষ্ট হলেও করি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখনো মানুষ মাটির তৈরি জিনিস কিনে। কিন্তু আগের তুলনায় অনেক কম। তারপরও এর মধ্যেই খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি। তিন ছেলে মেয়েকে পড়াশোনাও করাই। তবে এতে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। তারপরও পূর্বপুরুষের পেশা ছাড়তে পরি না।’

পালপাড়ার অংশপতি পাল বলেন, ‘বছর দুই হলো মাটির কাজ ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা করছি। মাটির কাজে এখন আর টাকা পাওয়া যায় না। তাছাড়া মাটির তৈজসপত্র বানাতে যে মাটি লাগে তা অনেক টাকা দিয়ে কিনতে হয়। অনেক সময় আবার বেশি টাকা দিয়ে কিনতে চাইলেও পাওয়া যায় না। তারপর আবার দিনরাত পরিশ্রম করে ন্যায্য দামও পাই না। তাই এই কাজ ছেড়ে দিয়েছি।’

মৃৎশিল্পের কাজ ছেড়ে দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে সুধীর পাল বলেন, ‘নদীর পাড়ে বাড়ি হওয়ার অনেক জায়গা ভেঙে গেছে। এতে আমাদের হাড়ি পাতিল পোড়ানোর চুল্লীটাও নদীতে চলে গেছে। আবার ছেলে মেয়েরা সবাই ব্যবসা বানিজ্য শুরু করছে তাই আর এই কাজ করা হয়না। এখন সরকার যদি আমাদের জন্য কোনো ব্যবস্থা করে দেন তাহলে আবার আমরা এই কাজ শুরু করতে পারবো।’

এলাকায় সুধীর পাল এবং অংশপতি পালের মতো দূর্গা দাস পাল, গোবিন্দ পাল, দুলাল পাল, নিতাই পাল, হরি পাল, শ্যামল পাল এমন অনেকে পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যবাহী পেশা ছেড়ে দিয়ে জড়িয়ে পড়েছে অন্য পেশায়। সবার একই কথা মাটির চড়া দাম, জ্বালানির দাম, পরিশ্রম বেশি, মাটির তৈজসপত্রের চাহিদা কম হওয়ার সবাই যাচ্ছে অন্য পেশায়। তাদের দাবি যদি মৃৎশিল্পকে বাঁচাতে হলে কারিগরদের পাশে সরকারের পাশে থাকা জরুরি। তাদের সহজে ঋনের ব্যবস্থা, মৃৎশিল্পের বাজার সৃষ্টি, জ্বালানি, জিনিসপত্র তৈরির সহজলভ্য কাঁচামাল পেলে আবার প্রাণ ফিরে পাবে মৃৎশিল্প।


শর্টলিংকঃ