মোগল যুগের সায়াহ্নে বাংলার অর্থনীতি


মোগল আমলে ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ ছিল, এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ কম। অর্থনীতির ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ পল ব্যারোক ১৯৯৫ সালে হিসাব করে দেখিয়েছেন, মোগল ভারতের মোট দেশজ উৎপাদন ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে ছিল প্রায় ৭৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার (১৯৯০ সালের মার্কিন ডলারের মান অনুযায়ী), যা ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে বেড়ে ৯০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে গিয়ে দাঁড়ায়। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে এর কাছাকাছি দেশজ উৎপাদন পৃথিবীতে খালি চীনের ছিল (৮৩ ট্রিলিয়ন)। ইউরোপের নেতৃস্থানীয় দেশগুলোর দেশজ উৎপাদন তখন বেশ কম—ফ্রান্সের ১৯ ট্রিলিয়ন, ইতালির ১৪, জার্মানির ১৩, আর মাত্র ১০০ বছর পরেই যে দেশ পৃথিবী শাসন করবে, সেই ইংল্যান্ডের টেনেটুনে ১১ ট্রিলিয়ন ডলার।

মোগল ভারতের এ দেশজ উৎপাদনের অনেকখানিই সুবাহ বাংলার অবদান। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার জনসংখ্যা ছিল তিন কোটির কিছু কম (এ সময়ে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল ৬০ কোটির কিছু বেশি), এ বিপুল জনসম্পদ সেই কৃষিনির্ভর অর্থনীতির যুগে বাংলা প্রদেশকে মোগল সাম্রাজ্যের সোনার ডিম পাড়া হাঁসে পরিণত করেছিল। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে মোগল সাম্রাজ্য বছরে বাংলার ওপর ১ কোটি ১৭ লাখ টাকা ভূমি-রাজস্ব ধার্য করেছিল, প্রদেশের ১ লাখ ৯ হাজার গ্রাম থেকে এ খাজনা আদায় করা হতো। গুজরাট, লাহোর, আজমের বা আগ্রার মতো সুবাহগুলো থেকে এর অর্ধেক ভূমি-রাজস্ব আদায় হতো, বিহার বা এলাহাবাদের ভূমি-রাজস্ব ছিল আরো কম।

বাংলায় মোগল আধিপত্য সত্যিকারভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে, যখন সুবাদার ইসলাম খান চিশতি বারো-ভুঁইয়াদের পরাজিত করে ঢাকায় মোগল রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে মগ দস্যুদের দমন করে শায়েস্তা খান বাংলার পূর্বাঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনেন। এর পরের চারটি দশক মোগল সুবাদাররা বাংলায় কৃষি সম্প্রসারণে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেন। তারা জঙ্গল কেটে কৃষিজমি বাড়িয়ে তোলেন, ব্যবসাকে উৎসাহিত করেন, রাজস্ব আদায়কারীদের শাসন করে কৃষি ও শিল্পপণ্যের ওপর বাড়তি কর আদায় বন্ধ করেন। ফলে বাংলায় কৃষি ও শিল্প উৎপাদন দুটোই উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছিল।

কিন্তু এ নিবন্ধে আমরা পর্যালোচনা করতে চাই বাংলার অর্থনীতি মোগল যুগের শেষ পর্বে কী অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল। এই শেষ পর্বের সূচনা ধরে নিতে পারি ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে, যখন সম্রাট আওরঙ্গজেবের আদেশে মুর্শিদকুলি খান বাংলার দেওয়ান হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে ঢাকায় এলেন।

১৭০০ খ্রিস্টাব্দেও বাংলার অর্থনীতি সমৃদ্ধ ছিল। বাংলার নদীবিধৌত সমতল ভূমিতে বিপুল পরিমাণ ফসলি জমির বেশির ভাগই ছিল দো-ফসলা। প্রতি বছর বাংলায় উৎপাদিত ধান এ প্রদেশের তিন কোটি মানুষের চাহিদা মিটিয়েও উত্তর ভারত, দক্ষিণ ভারত ও সিংহলে রফতানি করা যেত। শায়েস্তা খানের আমলের মতো অত সস্তা না হলেও মুর্শিদকুলি খানের আমলে টাকায় আড়াই মণ চাল পাওয়া যেত।

এ সময়ে বাংলায় গমের চাষও নিয়মিত হচ্ছিল। অভ্যন্তরীণ চাহিদা কম থাকায় উৎপাদিত গমের প্রায় পুরোটাই রফতানি হচ্ছিল। বাংলায় গম ছিল বেশ সস্তা, টাকায় তিন-সাড়ে তিন মণ। একই সময়ে ইউরোপে গমের দাম ছিল এর তিন গুণ।

কৃষিজ পণ্যের মধ্যে আরো রফতানি হচ্ছিল মরিচ, হলুদ ও আদা। বাংলার আখের গুড়ের চালান যাচ্ছিল ইরান ও ইরাকে। বাংলার পাট থেকে তৈরি চট ও দড়ি নিয়মিত রফতানি হতো, আর রফতানি হতো কার্পাস তুলা, রেশম। অল্প পরিমাণে হলেও রফতানি হতো ঘি, মাখন, আফিম, মদ, পান-সুপারি, শুকনো ফল। ঘি ছিল খুব সস্তা, টাকায় দশ সের।

কৃষিজ উৎপাদন ও রফতানির পাশাপাশি বাংলার অর্থনীতিতে শিল্পও তখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ইউরোপের শিল্প-বিপ্লবের ঢেউ তখনো পৃথিবীময় আছড়ে পড়েনি। বাংলার সে সময়ের দুটি শিল্প পৃথিবীতে শীর্ষস্থান দখল করে রেখেছে। প্রথমটি বস্ত্র শিল্প। বাংলার মসলিন ও রেশমি কাপড়ের খ্যাতি বিশ্ববাজারে তখনো মধ্যগগনে। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পুরো এশিয়া থেকে যে পরিমাণ কাপড় ইউরোপে পাঠাত, তার অর্ধেকের বেশিই যেত বাংলা থেকে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও নিয়মিত বাংলা থেকে ইউরোপে কাপড় পাঠাত। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ঢাকাকে বস্ত্র শিল্পের প্রাণকেন্দ্র বলে বিবেচনা করত, তাদের হিসাবে এখানে ৮০ হাজারের বেশি দক্ষ তাঁতি ছিল। ১৬৭৮-১৭১৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতি বছর গড়ে বাংলা থেকে ৪০ হাজার মসলিনের থান, দেড় লাখ ক্যালিকো থান আর ৪০ হাজার রেশম কাপড়ের থান রফতানি করেছে। একই সময়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সব মিলিয়ে প্রতি বছর গড়ে মোট দুই লাখ থান কাপড় রফতানি করেছে। শুধু মসলিন বা রেশম নয়, মোটা সুতি কাপড়ের উৎপাদনেও ঢাকার সুনাম ছিল। মুর্শিদকুলি খানের আমলে ১ পয়সায় একটি মোটা কাপড় পাওয়া যেত।

আরেকটি শিল্প, যেটি প্রায় বিস্মৃতির অতলে চলে গিয়েছে, সেটি হলো জাহাজনির্মাণ। আলেকজান্ডার হ্যামিলটন, ফিচ, লুডোভিকো এবং ফ্রাঁসোয়া পাইরাডের বিবরণী থেকে হিসাব করে ভারতীয় ইতিহাসবিদ ইন্দ্রজিৎ রায় দেখিয়েছেন, বাংলার সাতগাঁও, হুগলি ও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বছরে প্রায় ৪০০ জাহাজ তৈরি করে বিদেশে পাঠানো হতো। ইউনিভার্সিটি কলেজ অব ডাবলিনের গবেষকরা প্রমাণ করেছেন, বাংলার উন্নত জাহাজনির্মাণ শিল্প-প্রযুক্তি ইংল্যান্ডের জাহাজনির্মাতারা গ্রহণ করেছিলেন এবং বাংলার জাহাজের অনুকরণে ‘ফ্লাশ ডেক’ পদ্ধতি ব্যবহার করে ব্রিটিশ জাহাজকে সমুদ্রযাত্রায় নিরাপদ এবং পণ্য বহনে অধিকতর সক্ষম করে তোলেন।

বাংলার রফতানি পণ্যের মধ্যে আরো ছিল গন্ধক আর ইস্পাত, যদিও এ নিয়ে তেমন বিশদ তথ্য এখন পাওয়া যায় না।

অর্থনীতিতে সমৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হলো বাণিজ্য-ভারসাম্য কার অনুকূলে আছে। যে দেশ বেশি রফতানি করে, কম আমদানি করে, বাণিজ্য ভারসাম্য তারই অনুকূলে। বাংলার বিপুল পরিমাণ রফতানির তুলনায় তার আমদানি ছিল খুব সামান্য। অল্পকিছু শিল্প-কাঁচামাল (রেশম, তুলা, চামড়া) ছাড়া আমদানি হয়ে আসত কেবল বিলাসদ্রব্য (সুগন্ধি, তামাক, ঘোড়া ইত্যাদি)।

বাংলার এ বাণিজ্য-সুবিধার বলেই বাংলার মহাজনরা ‘ভারতের ব্যাংকারের’ মর্যাদা লাভ করেন। জগৎ শেঠ উপাধি পাওয়া মানিক চাঁদের সই করা হুন্ডি তখন ব্যাংক-নোটের সমান মর্যাদা পেত। মুর্শিদকুলি খানের মতো জাঁদরেল সুবাদারও মহাজনদের ক্ষমতা-প্রতিপত্তিকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণে সাহায্য করেছিলেন।

ব্যাপক শিল্পায়নের যা কিছু পূর্বশর্ত আছে, বাংলার অর্থনীতি ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে এসে তার প্রায় সবটাই পূরণ করেছিল। বাংলায় কাঁচামালের অভাব ছিল না, দক্ষ জনশক্তির অভাব ছিল না, পুঁজি বা জমির অভাব ছিল না। তবু বাংলায় ব্যাপক শিল্পায়ন হলো না। শিল্প বিপ্লব তো দূরের কথা।

হলো না সুশাসনের অভাবে, আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে শাসকদের দূরদৃষ্টি ও উদ্যোগের অভাবে। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুবাদার ছিলেন আজিম-উশ-শান। তিনি সম্রাট আওরঙ্গজেবের নাতি, শাহজাদা মুয়াজ্জমের পুত্র। আজিম-উশ-শান বাংলায় বাণিজ্যের প্রসারে উৎসাহী ছিলেন। ইংরেজ, ওলন্দাজ ও ফরাসি বণিকদের তিনি বেশি করে বাংলা থেকে পণ্য রফতানিতে উৎসাহ দিতেন। এতে বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ যে ক্রমেই তাদের হাতে চলে যাচ্ছে, এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন উদাসীন।

আজিম-উশ-শানের দেওয়ান হিসেবে কাজ করার সময় মুর্শিদকুলি খান তার সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। তিন বছর পরেই সম্রাটের নির্দেশে আজিম-উশ-শানকে সরে যেতে হলো, দেওয়ানের পদে থেকেই বাংলার খেতাবহীন সুবাদার হিসেবে দায়িত্ব বুঝে নিলেন মুর্শিদকুলি খান। সম্রাটের কাছে নিজের যোগ্যতা প্রমাণের জন্যে তিনি রাজস্ব আদায়ের ওপর খুব জোর দিলেন। ১৭ বছরে রাজস্ব আদায়ের হার ৪০ শতাংশ বাড়িয়ে মুর্শিদকুলি খান সম্রাটের প্রিয়পাত্র হলেন, সুবাদার হিসেবে আনুষ্ঠানিক নিযুক্তি পেলেন, মুকসুদাবাদের নাম পাল্টে নিজের নামে মুর্শিদাবাদ করে নিলেন। কিন্তু তার এ ব্যক্তিগত সৌভাগ্য এল বাংলার অর্থনৈতিক স্থবিরতার বিনিময়ে।

প্রথমত, ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঢাকা থেকে বাংলার রাজধানী সরিয়ে নিয়ে মুর্শিদাবাদে বসালেন। ঢাকা তখন বাংলার শিল্প ও বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। এখান থেকে শাসকের মনোযোগ সরে যাওয়ায় ব্যবসার উন্নতিতে প্রশাসনিক সহযোগিতাও কমে গেল। মুর্শিদকুলি খান ঢাকা থেকে জগৎ শেঠের মতো বড় মহাজনদেরও সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। আর্থিক ব্যবস্থাপনার কেন্দ্র হিসেবেও ঢাকা তার গুরুত্ব হারাল।

দ্বিতীয়ত, মুর্শিদকুলি খানের দক্ষতা ছিল ভূমি ব্যবস্থাপনায়। সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর অন্য মোগল সম্রাটদের আনুগত্যের প্রমাণ দিতে গিয়ে আরো আগ্রাসী রাজস্ব ব্যবস্থাপনা হাতে নিলেন। ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘কামিল জমা তুমারি’ নামের নতুন রাজস্ব ব্যবস্থাপনার আওতায় বাংলাকে তের চাকলায় ভাগ করলেন, জমিদার ও মনসবদারদের কঠোরভাবে চাপ দিয়ে টাকা আদায় করতে শুরু করলেন। এতে রাজস্বের পরিমাণ বাড়ল ঠিকই, কিন্তু দুটো ক্ষতি হয়ে গেল। বাংলায় অভাব দেখা দিল, জিনিসপত্রের দাম বাড়ল, তরল টাকার প্রায় সবটাই দিল্লিতে চলে যাওয়ায় পুঁজি সংকট দেখা দিল। তার চেয়েও বড় ক্ষতি হলো, করভারে পীড়িত জমিদার, মনসবদাররা আর নগদ বেতনে সৈন্য প্রতিপালন করতে পারলেন না। বাংলার সৈন্যেরা চাকরি হারাল—বেকারত্ব মেনে নিল কিংবা অন্য প্রদেশে চাকরির সন্ধানে গেল। বাইরের শত্রুর হাত থেকে বাংলার আত্মরক্ষার ক্ষমতা কমে গেল।

মুর্শিদকুলি খান ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দে মারা গেলেন, কিন্তু মোগল বাংলার রাজধানী আর কখনো ঢাকায় ফিরে আসেনি। তার জামাই সুজাউদ্দিন নিজেকে নবাব হিসেবে ঘোষণা দিয়ে মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে বসলেন। কিন্তু রাজস্ব ব্যবস্থা আগের মতোই নিবর্তনমূলক থেকে গেল। বাণিজ্যের প্রসারে নবাব সুজাউদ্দিন তেমন মনোযোগ দেননি।

সুজাউদ্দিনের মৃত্যুর পর তার ছেলে সরফরাজ খান নবাব হয়েছিলেন। কিন্তু বিহারের নায়েবে নাজিম আলিবর্দি খান সরফরাজকে আক্রমণ করে হত্যা করলেন, ক্ষমতা দখল করলেন। এ অন্যায় ক্ষমতারোহণকে জায়েজ করতে তাকে মোগল সম্রাটকে ঘুষ দিতে হলো। যুদ্ধের ব্যয়, ঘুষ, সভাসদদের অপব্যয়—সব মিলিয়ে বাংলার অর্থনীতি আবার চাপের মুখে পড়ল।

 

তারপর ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে এল প্রথম দুর্যোগের ঢেউ। মারাঠা বাহিনী বাংলা আক্রমণ করল। বাংলার নবাব মারাঠাদের ঝটিকা আক্রমণের সামনে অসহায় হয়ে পড়লেন। বাংলার চার লাখ মানুষ মারা পড়ল, এক লাখ মানুষকে ধরে নিয়ে দাসত্বে বাধ্য করল মারাঠা বাহিনী। ভাগীরথী আর গঙ্গার তীর প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ল। অর্থনীতিতে এর কেমন বিরূপ প্রভাব পড়েছিল, তা সহজেই অনুমান করা যায়।

নবাবদের কর্তৃত্ব কমতে শুরু করল, বাণিজ্য ক্ষেত্রে ক্রমেই ক্ষমতাবান হয়ে উঠতে শুরু করল ইউরোপীয় বণিক, বিশেষ করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৬৯৭ সালেই ব্রিটেনের সংসদ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভারতে ব্যবসার একচেটিয়া অধিকার দিয়েছিল। ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট ফররুখশিয়ার তাদের বাংলায় বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতি দেন। বাংলার ব্যবসায়ীরা যখন সব পণ্যের ব্যবসায় ২০-৩০ শতাংশ শুল্ক দিচ্ছেন, তখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিনা শুল্কে বাণিজ্যের এ অভাবনীয় সুবিধা কাজে লাগিয়ে সব ধরনের বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও ব্যবসা বাঁচাতে তাদের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে আলিবর্দির নাতি সিরাজউদ্দৌলা নবাবের সিংহাসনে বসার পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃত্ব খর্ব করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ততদিনে বড় দেরি হয়ে গেছে।

এভাবেই বাংলার অর্থনীতির ভিত্তি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে পলাশীর প্রান্তরে যুদ্ধের অনেক আগেই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অর্থনীতির যুদ্ধে জয়ী হয়ে রাজ্যশাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে ফেলেছিল। আর পলাশীতে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর মীর জাফর বা মীর কাসিম নবাব হতে পারলেও ব্যবসা-বাণিজ্যের কর্তৃত্ব কখনো ফেরত পাননি।

বাংলার অর্থনীতির প্রবাদপ্রতিম সমৃদ্ধির সূর্যও অস্ত গিয়েছে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দেই। দুই দশক আগেও যে বাংলা বিশ্বে চাল রফতানি করত, ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের ইতিহাস—কুখ্যাত এক দুর্ভিক্ষে সেখানে ১২ লাখ লোকের মৃত্যু হলো। কাপড় রফতানির বদলে কাপড় আমদানি করতে হলো, জাহাজনির্মাণ শিল্প প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ল।

১৭০০-৫৭ খ্রিস্টাব্দের বাংলার অর্থনৈতিক ইতিহাস আমাদের বলে, প্রবৃদ্ধি বা দেশজ উৎপাদনের উচ্চহার সমৃদ্ধির নিশ্চয়তা নয়। রাজনৈতিক দূরদর্শিতা না থাকলে, প্রযুক্তির উন্নয়ন ও উদ্ভাবনে যথেষ্ট বিনিয়োগ না থাকলে এবং বাণিজ্যে স্থানীয় কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ন রাখতে না পারলে সমৃদ্ধি ধরে রাখা যায় না। সে সমৃদ্ধি আবার ফিরে পেতে লেগে যেতে পারে দুই-আড়াইশ বছরের বিদেশী শাসন, রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রাম, পুনর্গঠনের আধা-শতাব্দী বিস্তৃত প্রয়াস।

 

খন্দকার স্বনন শাহরিয়ার: গবেষক ও মধ্যযুগের বাংলা: বখতিয়ার খলজি থেকে সিরাজ-উদ-দৌলা গ্রন্থের প্রণেতা।


শর্টলিংকঃ