রায়ের আগেই চরম ভোগান্তি


ইউএনভি ডেস্ক:

ফেসবুকে ‘মিথ্যা গুজব’ ছড়ানোর অভিযোগে দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ কর্তৃপক্ষ। ২০১৫ সালে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় এ মামলাটি করা হয়। ওই বছরের ২৯ অক্টোবর ওই দুই শিক্ষককে এ মামলায় গ্রেফতার করে পুলিশ। ২৭ দিন কারাভোগের পর তারা জামিনে মুক্ত হন। তদন্ত শেষে ২০১৭ সালে ওই দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেয়া হয়।


এরপর ট্রাইব্যুনাল চার্জশিট আমলে নিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ (অভিযোগ) গঠন করেন। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি এ মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে ট্রাইব্যুনাল শিক্ষক মো. ফারুক হোসেনকে বেকসুর খালাস দেন। আর রায় ঘোষণার আগেই ২০১৮ সালে ‘মামলার কলঙ্ক’ মাথায় নিয়ে অপর শিক্ষক আনোয়ার সাহাদাত মারা যান।

শুধু এ মামলাটিই নয়, সাইবার ক্রাইমের অভিযোগে করা অধিকাংশ মামলায়ই আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। ট্রাইব্যুনালের নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, সাক্ষ্য-প্রমাণ না থাকায় মোট ৪ ভাগের ৩ ভাগ মামলার রায়েই আসামিরা খালাস পেয়েছেন। গত ৮ বছরে ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনালে ১২৮টি মামলার রায় হয়েছে। এর মধ্যে সাজা হয়েছে ৩০টি মামলায়। বাকি ৯৮টি মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন। অর্থাৎ শতকরা ২৩ দশমিক ৪৩ ভাগ মামলায় সাজা হয়েছে। আর ৭৬ দশমিক ৫৬ ভাগ (প্রায় ৭৭) মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় তছনছ হচ্ছে অনেকের ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন। ‘বিতর্কিত’ এ আইনের অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে শুরু থেকেই। সম্প্রতি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় লেখক ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট মুসতাক আহমেদ কারাবন্দি অবস্থায় মারা যাওয়ার পর বিষয়টি সামনে এসেছে। ভিন্নমত দমনে আইনটির অপপ্রয়োগ বাড়ছে- এমন অভিযোগে আইনটি বাতিলের দাবিতে দেশের ভেতর-বাইরে নতুন করে শুরু হয়েছে আন্দোলন। ডিজিটাল স্পেসে সংঘটিত অপরাধের জের ধরে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা করছেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা। যার সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। সর্বনিু শাস্তি এক বছরের জেল। অথচ অনেকেই নিজের অজান্তেই মোবাইল স্ক্রল করতে করতে অবহেলা, অবলীলায় এ আইনের অপরাধ করে ফেলছেন। মামলার পরিসংখ্যান ও তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিভিন্ন ধারায় হয়রানির সুযোগ আছে উল্লেখ করে সাংবাদিক, সুশীল সমাজ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকেও উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দেয়া হয়েছে। শুরু থেকেই আইনটি নিয়ে আপত্তি ছিল সর্বমহলের। আইনটি কার্যকর হওয়ার পর মাত্র দুই বছরেই শত শত মামলায় বহু মানুষকে জেল খাটতে হয়েছে। কারাগারে লেখক মুস্তাক আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে দ্রুত স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলে। বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তিনি এ দাবি জানান। সরকারও এ আইনটির অপব্যবহার যেন না হয় সেদিকে গুরুত্বারোপ করছে। তদন্তের আগে যেন মামলা ও গ্রেফতার না করা হয় সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে যুগান্তরকে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী।

জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক শনিবার রাতে টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, এ আইনে কোনো অপরাধের অভিযোগ এলে পুলিশি তদন্তের আগে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না বা তার বিরুদ্ধে মামলা নেওয়া যাবে না- এমন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আমরা বলেছি, সরাসরি মামলা নেওয়া হবে না। কোনো অভিযোগ এলে পুলিশ প্রথমে তদন্ত করে দেখবে। তারপর মামলা নেওয়া হবে।

কিন্তু আইনটি প্রণয়নের পর থেকে কোনো অভিযোগ এলেই পুলিশ মামলা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই অভিযুক্তকে আটক করছে- এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী বলেন, আগে যাতে আটক না করে এবং তদন্তের জন্য যেন অপেক্ষা করে- সেই জায়গায় আসার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। জামিন হওয়া না-হওয়ার প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, সাজা যতটা হলে জামিন হবে এবং যতটা হলে জামিন হবে না- ঠিক সেই প্রিন্সিপালটা অনুসরণ করে আমরা বিধান করেছি। সারা পৃথিবীতেই এটা করা হয়। এমনকি এ উপমহাদেশেও। বিষয়টা নিয়ে আমরা আলাপ-আলোচনা করছি। এসব ব্যবস্থা নিতে আইনের সংশোধনের প্রয়োজন নাও হতে পারে এবং বিধির মাধ্যমে সেটা করা যেতে পারে।

মামলায় সাজা ও খালাস প্রসঙ্গে সাইবার ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) নজরুল ইসলাম (শামীম) যুগান্তরকে বলেন, সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা চলাকালে অনেক অভিভাবক এসে বলেন, আমার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। সে সুখে-শান্তিতে আছে। আমরা মামলা আর চালাতে চাই না। এমনকি উপজেলা চেয়ারম্যান বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও নিয়ে আসেন। তারা বলেন, এ মামলা চললে মেয়ের ক্ষতি হতে পারে। তার সংসারে অশান্তি হতে পারে। তাই মামলা প্রত্যাহার চান। ফলে অনেক মামলা প্রত্যাহার হয়। আবার অনেকেই ট্রাইব্যুনালের বাইরে সমঝোতা করে আসামির পক্ষে মামলার অভিযোগের বিপরীতে উল্টো সাক্ষ্য দেন। ফলে মামলায় আসামিপক্ষ সুবিধা পায়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়রানির জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রাথমিক হয়রানি হয়ে গেলে কিংবা উদ্দেশ্য পূরণ হলে তারা আর মামলার খোঁজখবর নেন না, সাক্ষ্য দেন না। এভাবে দীর্ঘদিন সাক্ষ্য না হলেও পরিশেষে আসামিপক্ষ এর সুবিধা পান। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মামলায় কোনো আসামিকে সাজা দিতে হলে সর্বপ্রথম পুলিশ সাক্ষী এবং সাধারণ সাক্ষীদের ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষী দিতে হবে। সাক্ষীরাই আসামিকে সাজা দিতে রায়ে বড় ভূমিকা রাখেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি ‘সাইবার ট্রাইব্যুনাল (বাংলাদেশ), ঢাকা’ গঠন করা হয়। ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের ৪ মার্চ পর্যন্ত সারা দেশের বিভিন্ন থানা থেকে বিচারের জন্য সাইবার ট্রাইব্যুনালে মোট মামলা এসেছে তিন হাজার ৩২৪টি। প্রতি বছরই মামলার সংখ্যা বাড়লেও শুধু গত বছর কিছুটা কমেছে। ২০২০ সালে ৬২২টি, ২০১৯ সালে ৭২১টি, ২০১৮ সালে ৬৭৬টি, ২০১৭ সালে ৫৬৮টি, ২০১৬ সালে ২৩৩টি, ২০১৫ সালে ১৫২টি, ২০১৪ সালে ৩৩টি এবং ২০১৩ সালে ট্রাইব্যুনালে এসেছে ৩টি মামলা। চলতি বছরের ৪ মার্চ পর্যন্ত থানা থেকে মোট মামলা এসেছে ৩১৬টি। এসব মামলার মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে নারীদের হয়রানি, প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে ফেসবুকে আপত্তিকর স্ট্যাটাসসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে করা বিভিন্ন মামলা রয়েছে। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে প্রায় দুই হাজার ৪৫০টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এরমধ্যে দুই হাজার ৬০টি মামলা থানা থেকে এসেছে এবং বাকি ৩৯০টি ট্রাইব্যুনালে করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এ আইনের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হচ্ছে- আসামির অপরাধ অজামিনযোগ্য। ফলে যাচাই-বাছাই ছাড়া মামলা নিয়ে পুলিশ আসামিকে গ্রেফতার করলে লম্বা সময়ের জন্য তাকে কারাবাস করতে হয়। এর বড় প্রমান কার্টুনিস্ট কিশোর। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের জোরালো দাবির পরও প্রায় ৯ মাস কারাভোগের পর জামিনে মুক্তি পান তিনি।

এদিকে আইনটি বাতিলের আন্দোলন জোরদার হওয়ার মধ্যেই সাইবার অপরাধীদের সামাল দিতে পুলিশি কার্যক্রমেও আনা হয়েছে ব্যাপক পরিবর্তন। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে শুরু করে পুলিশের প্রায় সব ইউনিটে সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও তদন্তের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। স্থাপন করা হয়েছে অত্যাধুনিক ল্যাব।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম যুগান্তরকে বলেন, সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ হিমশিম খাচ্ছে। এ কারণে নতুন ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। এ ইউনিটের সদস্যদের প্রশিক্ষণসহ অত্যাধুনিক সরঞ্জাম সংযুক্ত করা হচ্ছে। তবে সাইবার আইন নিয়ে যেহেতু বিতর্ক উঠেছে সেহেতু আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক সাবধানতা অবলম্বন করতে হচ্ছে। ফলে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী আইন প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। সাইবার অপরাধ এড়িয়ে চলতে সবাইকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে বিস্তারিত জানার পরামর্শ দেন তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাইবার অপরাধ দমনে পুলিশ সদর দপ্তরে সাইবার সিকিউরিটি সেল নামের আলাদা ইউনিট রয়েছে। এ ইউনিটে কাজ করছেন পুলিশের প্রশিক্ষিত সদস্যরা। তারা সাইবার অপরাধীদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী গুজব রটনাকারীদের ধরতে সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন তারা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) রয়েছে সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। এ বিভাগে এখন তদন্তাধীন মামলার সংখ্যা ৬৫। এ ইউনিটের জন্য অত্যাধুনিক ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে।

ডিবির সাইবার ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে যুগান্তরকে বলেন, অনেকেই মনের অজান্তেই ফেসবুকের অনেক ফিডে ক্লিক করে সাইবার অপরাধে পা রাখেন। অথচ সেটি তিনি বুঝতেই পারেন না। না বুঝে না জেনে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন কাজ করে থাকেন। যেগুলো এক সময় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপরাধের আওতায় এসে যায়।

সাইবার ক্রাইম নিয়ন্ত্রণে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ইউনিটেও রয়েছে আলাদা শাখা। এ শাখায় এখন তদন্তাধীন মামলার সংখ্যা ১৩১। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডিতেও সাইবার ক্রাইম নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যাধুনিক একটি ইউনিট আছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সর্বোচ্চ সংখ্যক ২ শতাধিক মামলা এখন তদন্তাধীন সিআইডির এ ইউনিটে। এ ইউনিটের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য সহকারী পুলিশ সুপার (বর্তমানে ঝিনাইদহ সিআইডিতে কর্মরত) সুমন কুমার দাস যুগান্তরকে বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বেশিরভাগ অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ফেসবুকে বিভিন্ন ধরনের হয়রানি, ফেসবুক হ্যাক করে ব্ল্যাকমেইলের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়, অনলাইনে গুজব ছড়ানো ও রাষ্ট্র অবমাননার ঘটনায় মামলা হচ্ছে।


শর্টলিংকঃ