সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যার না-জানা কথা


ইউএনভি ডেস্ক:

ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় বাংলাদেশের তিন দিকেই রয়েছে ভারত। কেবল দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। তবে দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমারের সঙ্গে মাত্র ২৭০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশের। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে সীমান্তের আয়তন ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার। ।

সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যার না-জানা কথা

ভারতের পাঁচটি রাজ্য বাংলাদেশ সীমান্তের সঙ্গে যুক্ত। রাজ্যগুলো হচ্ছে—পশ্চিমবঙ্গ (২ হাজার ২১৬ কিলোমিটার), আসাম (২৬৩ কিলোমিটার), মেঘালয় (৪৪৩ কিলোমিটার), ত্রিপুরা (৮৫৬ কিলোমিটার) ও মিজোরাম (৩১৮ কিলোমিটার)। অন্যদিকে বাংলাদেশের ৩২ জেলার সঙ্গে দুই দেশের সীমান্ত সংযুক্ত। এই বিশাল সীমান্ত জুড়ে রয়েছে—সমতল ভূমি, নদী, পাহাড়, বন এবং আবাদি জমিসহ বসতভিটা

নব্বইয়ের দশকের সূচনা থেকে দুই দেশের মধ্যেকার অর্থনৈতিক সম্পর্ক দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। অপরদিকে গবাদি পশু, স্বর্ণ, মাদক ও অস্ত্রশস্ত্র চোরাচালান এবং মানব পাচারের কারণে মাঝেমধ্যেই দুই দেশের সীমান্ত উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এসব সমস্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) এবং ভারতের সীমান্ত রক্ষা বাহিনীকে (বিএসএফ) হিমশিম খেতে হয়। তবে প্রায়ই বিএসএফের বিরুদ্ধে সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যার অভিযোগ পাওয়া যায়। এতে বাংলাদেশের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়। বিশেষ করে, দুই দেশের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে সীমান্তে মানব হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও হত্যাকাণ্ড বহাল থাকায় ক্ষোভের মাত্রা বাড়ে।

ভারত সরকার অবশ্য দুই দেশের সীমান্ত দিয়ে গবাদি পশু পাচার রোধকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। সীমান্তবাসী, বিশেষ করে আদিবাসী জনগোষ্ঠী সহজে বড়ো উপার্জনের লোভে এই পাচারে জড়ায়। বিশাল সীমান্ত হওয়ায় তা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ কাজ নয়। এই দুর্বলতাকে কাজে লাগাচ্ছে চোরাকারবারিরা। ভারতে গরু (গবাদি পশু) রপ্তানি নিষিদ্ধ হয়েছে প্রায় তিন বছর। এর আগে ভারত থেকে বৈধভাবে বাংলাদেশে গরু আমদানি করা হতো। সেই সঙ্গে শুল্ক ফাঁকি দিতে কিছুসংখ্যক গরু চোরাই পথেও আসত। এখন বৈধভাবে আমদানি বন্ধ হওয়ায় অবৈধদের তৎপরতা বেড়েছে। চোরাচালিরা গরু পাচারের জন্য সাধারণত দুর্গম পথ এবং টহলের শিথিলতাকে কাজে লাগায়।

বাংলাদেশে গরু কেনাবেচা অবৈধ না হওয়ায় ওপার থেকে নিয়ে আসার পর শুল্ক বিভাগের কর দিয়ে তা বৈধ করে নেওয়া যায়। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত জুড়ে রয়েছে গরুর বিশাল বিশাল বাজার। এসব বাজার মূলত চোরাচালানের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশে বছরে ৫০ কোটি ডলারের গরুর চাহিদা রয়েছে। পবিত্র ঈদুল আজহার সময় দেশে গরুর চাহিদা বহু গুণে বেড়ে যায়। তবে সুখের খবর হচ্ছে, ভারত থেকে গরু রপ্তানি বন্ধ হওয়ার পর বাংলাদেশে গবাদিপশু পালন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

তবে এখনো তা চাহিদা পূরণের পর্যায়ে পৌঁছায়নি। ভারতের দেওয়া হিসাবমতে, সীমান্ত দিয়ে প্রতি বছর প্রায় ১৫ লাখ গরু পাচার হয়। বাংলাদেশে ঈদুল আজহার সময় একটি অল্প বয়সি গরু ৪০ হাজার টাকয় বিক্রি হয়। অন্যদিকে একই গরুর দাম ভারতে তখন আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকা মাত্র। পূর্ণ বয়স্ক একটি গরু ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। একই গরুর দাম ভারতে তখন ৪৫ হাজার টাকা। এ ধরনের উচ্চ পার্থক্যের কারণে গরু পাচারকারীরা জীবন যাওয়ার মতো ঝুঁকির কথা ভুলে যায়। এমনকি তারা পাচারকাজে শিশুদেরও নিয়োগ দিয়ে থাকে।

মানকারচর, এমন একটি স্থান, যার সঙ্গে আসাম-মেঘালয় ও বাংলাদেশ যুক্ত। স্থানটি গরুর চারণভূমি হিসেবে পরিচিত। এখানে গবাদি পশুর হাত বদল হয় ‘হাওলা’র মাধ্যমে। মেঘালয়ে গবাদি পশুর বাজার ‘গরুবাঁধা’ হচ্ছে গারো হিলের পশ্চিম থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার এবং বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমান্তের ২২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। দুটি এলাকাই আসামের মানকারচরের কাছাকাছি। গরুবান্ধায় সপ্তাহে ৫০০ গরু-মহিষ কেনাবেচা হয়ে থাকে। ঈদুল আজহার আগে এই সংখ্যা ৩ হাজার ছাড়িয়ে যায়। বাংলাদেশের খাটালে (পশুর হাট) পৌঁছাতে এসব গবাদি পশুকে কয়েক শ কিলোমিটার পাড়ি দিতে হয়। এসব গবাদি পশু আনা হয় প্রধানত রাজস্থান, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, বিহার ও ঝাড়খণ্ড থেকে। সীমান্ত পার হতে গরুর ব্যাপারীরা বন্ধুর রাস্তা বা কালিন্দি, ইছামতি, রায়মঙ্গল ও হাঁড়িভাঙ্গার নদীপথ ব্যবহার করে থাকে।

অপরিচিত স্থান হওয়ায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে গবাদি পশুর চোরাচালান রোধে বিএসএফকে হিমশিম খেতে হয়। এই রাজ্যের বিভিন্ন সীমান্তে দায়িত্ব পালনকালে উভয় পারের সন্ত্রাসী চক্রের দ্বারা বিএসএফ-এর আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। মূলত ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত খুবই জটিল। এখানে নদী-নালাসহ আড়াআড়ি সীমান্তও রয়েছে। সেই সঙ্গে ঘনবসতি যা কোথাও কোথাও শূন্যরেখা ঘেঁষে বিদ্যমান। এ কারণে কখনো কখনো বিএসএফ অসহায় হয়ে পড়ে। জানা যায়, আঁধার, কুয়াশা এবং হাতির খাবারের জন্য বেড়ে ওঠা ঘাসকে আড়াল করে হরুমপুর ও মালদার জলসীমান্ত দিয়ে ২৫০ থেকে ৩০০ জন পর্যন্ত গরুর রাখাল (কারবারি) একসঙ্গে ভারতে অবৈধভাবে প্রবেশ করে। এছাড়া কলকাতা ও কৃষ্ণনগর সীমান্ত দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া কেটে বা ফাঁক গলিয়ে ছোটো ছোটো গ্রুপও সীমান্ত পার হয়।

বিএসএফ-এর ভাষ্যমতে, তাদের হাতে থাকে দা, কুড়াল, ছোরা, চাকু ও বাঁশের লাঠির মতো দেশীয় অস্ত্র এবং তীব্র আলো ছড়ায় এমন টর্চলাইট। আবার কারো কারো কাছে থাকে হাতে তৈরি বোমা (যাকে স্থানীয়রা ‘সকেট’ নামে চেনেন), পিস্তল ও রিভলভার। সীমান্ত পারাপারের সময় পশুগুলো যাতে মারমুখী রূপ ধারণ না-করে, সেজন্য তাদের দেহে ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক প্রবেশ করায় রাখাল বা পাচারকারীরা। তারা গরু পাচারের সময় একটি বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে থাকে। আর তা হচ্ছে পাচারের উদ্দেশ্যে বিপুলসংখ্যক গরু এনে সীমান্তের কাছাকাছি এক জায়গায় জড়ো করা।

এরপর অস্ত্রশস্ত্রসহ অগ্রবর্তী দল হিসেবে কয়েকটি গরু পাঠায়। তারা নিরাপদে সীমান্ত অতিক্রম করলে দ্বিতীয় দল পাঠায়। তারাও নিরাপদে পৌঁছালে তৃতীয় বা শেষ দলটি যায়। সব দলই অস্ত্রশস্ত্রে সমৃদ্ধ থাকে বলে দাবি করা হয়। সাধারণত ভারত সীমান্তবর্তী দুর্গম গ্রামগুলো পাচারের জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সেখানে গবাদি পশুগুলোকে একটার সঙ্গে আরেকটাকে লোহার শিকল দিয়ে বাঁধা হয়। এরপর রাত গভীর হলে রাখাল কিংবা সাঁতার জানে, এমন স্থানীয় যুবককে দিয়ে গরুগুলোকে নদী পার করানো হয়। তাছাড়া কাঁটাতারের বেড়া কেটে কিংবা বেড়া নেই, এমন জায়গা দিয়েও বাংলাদেশে গরু পাচার করে। সীমান্ত পার করানো বাবদ রাখালরা প্রতি ট্রিপের জন্য ৩ হাজার টাকার মতো পেয়ে থাকেন।

গরু চোরাচালানিরা পাচারকাজে নৌপথকেও ব্যবহার করে থাকে। এ সময় তারা কলাগাছের ভেলার মাঝখানে গরুর মাথা বেঁধে নদীতে নামায়। তারা এমন স্থানকে গরু পাচারের জন্য বাছাই করে, যেখানে নদী ৭০০ থেকে ৮০০ মিটার চওড়া। পশ্চিমবঙ্গের মালদহ, মুর্শিদাবাদ, উত্তর চব্বিশ পরগনা ও নদীয়া জেলা থেকে, বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে ভরা নদীতে পাচারের পশুগুলোকে নামানো হয়। এরপর স্রোতের টানে সেগুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চলে আসে।

পাচার প্রতিরোধ করতে গিয়ে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী প্রায়ই গরুর ব্যাপারীদের টার্গেট হয়। পাচারকারীরা বাধাগ্রস্ত হলে রক্ষীবাহিনীর ওপর গুলি ছুড়তেও দ্বিধা করে না। বিএসএফের দাবিমতে, গলায় টাইম বাঁধা গরুও তারা উদ্ধার করেছে। যারা গরু ধরতে যাবে, তাদের বোমা বিস্ফোরণে ক্ষতবিক্ষত করাই এই কৌশলের লক্ষ্য। এ ধরনের হিংস্র কৌশলের আশ্রয় নিলে গরু ধরার সময় বিস্ফোরণে গরু ও রক্ষীবাহিনী উভয়েই ছিন্নভিন্ন হতে পারে।

সম্প্রতি গলায় টাইম বাঁধা কয়েকটি গরু দক্ষিণ বাংলা সীমান্ত বরাবর হারুডাঙ্গা সীমান্ত চৌকির কাছ থেকে আটক করা হয়েছে বলে বিএসএফ জানায়। এমনকি গরু পাচারের উদ্দেশ্যে দুই দেশের ভূখণ্ডের তলদেশ দিয়ে বানানো সুড়ঙ্গেরও সন্ধান নাকি বিএসএফ পেয়েছে। বিজিবির তরফ থেকে অবশ্য এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। আসামের করিমগঞ্জে সুড়ঙ্গের এক মাথার সন্ধান পাওয়া গেছে বলে খবর ছড়ালে বিষয়টি আলোচনায় আসে। মানুষের তৈরি এই সুড়ঙ্গ তৈরি করতে সুয়ারেজের মোটা পাইপ ব্যবহার করা হয়েছে। এর মুখ ঘন গাছপালা দিয়ে ঢেকে দেওয়া। গরু পাচারের উদ্দেশ্যে এধরনের দেশীয় প্রযুক্তি ছাড়াও পাচারকারীরা গরুর পায়ের নিচে ভারী কাঠ বেঁধে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। এর ফলে বহু গরু মাঝপথে মারাও যায়।

বিএসএফ সীমান্ত বরাবর ৭২৫টি চৌকিতে এ পর্যন্ত ৪৫টি ব্যাটালিয়ন মোতায়েন করেছে। বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তের উভয় দিকের চোরাকারবারিদের মধ্যে যে সুনিবিড় সম্পর্ক রয়েছে, তা সহজেই অনুমান করা যায় এবং তারা প্রতিনিয়ত একে অপরকে টহল সৈন্যদের গতিবিধির খবর সরবরাহ করে থাকে।

এদিকে বিএসএফের বিরুদ্ধে প্রায়ই সীমান্তে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের খবর পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে বিএসএফের জবাব হচ্ছে, তারা আত্মরক্ষার্থে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। তাদের দাবি, এ ধরনের ঘটনায় শুধু বাংলাদেশি প্রাণ হারাচ্ছে না, ভারতীয় জওয়ানরাও প্রাণ দিচ্ছে।

এ ধরনের ঘটনা প্রতিহত করতে পশ্চিমবঙ্গে ভারতীয় সীমান্তে বরাবর ১৫৯টি নাজুক স্থানকে চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্যদিকে সীমান্তে প্রহরা জোরদার করার প্রেক্ষাপটে চোরাকারবারিরা গরু পাচারের জন্য আরো বেপরোয়া ও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশি মিডিয়া বিদেশি গণমাধ্যম সীমান্তে চোরাচালান দমনে বিএসএফের বাড়াবাড়ির কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিএসএফের বক্তব্য হচ্ছে, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের আন্তর্জাতিক সীমান্ত নিরাপদ রাখতে বিএসএফকে যে ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে, সমালোচনায় তা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। বাস্তবে তাদের দুর্গম সীমান্ত এবং চোরাচালানিদের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষ মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক সীমান্ত সুরক্ষায় তারা সীমান্ত চৌকি শক্তিশালী, কাঁটাতারের মতো অবকাঠামো নির্মাণ এবং গোপন সেতু-কালভার্ট, সড়কের মতো স্থাপনা নিশ্চিহ্ন করাসহ কয়েকটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে দুই দেশের দুই রক্ষীবাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা গেলে সবচেয়ে বেশি সুফল পাওয়া যেতে পারে। কেবল সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ আর মানব হত্যার মাধ্যমে এই সমস্যার আশু সমাধান সম্ভব নয়।


শর্টলিংকঃ