অসুস্থতা নিয়েও করোনা ল্যাবের অগ্রভাগে চিকিৎসক দম্পতি


নিজস্ব প্রতিবেদক :

করোনা শনাক্তে নিবেদিতপ্রাণ এই চিকিৎসক দম্পতি এ্যাজমা,উচ্চ রক্তচাপ,গাউটসহ বিভিন্ন শারীরিক নানা অসুস্থতায় ভুগছেন। শ্বাসকষ্টের কারণে অনেক সময়ই চিকিৎসকের পরামর্শে ইনহেলা ব্যবহার করে অধ্যাপক বুলবুল। এমন কি তিনি কর্মক্ষেত্রেও ইনহেলা সাথে নিয়ে আসেন। শুধুমাত্র এই জাতীয় দুর্যোগে মানুষকে সেবা দিতে তারা করোনা  ল্যাবে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। যা দেশে বিরল ঘটনা বলে মনে করেন অনেকেই।

চিকিৎসক দম্পতি অধ্যাপক বুলবুল হাসান ও অধ্যাপক সাবেরা গুল নাহার

ঢাকা ও চট্টগ্রামের পরই রাজশাহী করোনা শনাক্তে ল্যাব স্থাপনের কথা ওঠে। কিন্তু অবকাঠামো ও জনবল সংকটের কারণে তা সহজ ছিল না। তবে এতো বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সাহসী হয়ে এগিয়ে আসেন মাইক্রোবায়লজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. বুলবুল হাসান ও ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সাবেরা গুলনাহার। এই চিকিৎসক দম্পতির আন্তরিক প্রচেষ্টা ও মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষডা. নওশাদ আলীর সহযোগিতায় মাত্র চারদিনে স্থাপিত হয় করোনা ল্যাব। এ ল্যাবেই রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন জেলার করোনা পরীক্ষা হচ্ছে।

গত ১ এপ্রিল থেকে রাজশাহীতে করোনা পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর থেকে এ যুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন বুলবুল-সাবেরা দম্পতি। রাজশাহীতে করোনা ল্যাব প্রতিষ্ঠিত করার সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যেখানে অন্যরা হাত গুটিয়ে সেখানে এই দম্পতি রাত-দিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন করোনাযুদ্ধের সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে। করোনা পরীক্ষা করতে গিয়ে খুব কাছে থেকেই এ মরণভাইরাসের মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রতিদিন তাদের। তবুও এ পথচলা থেমে নেই। নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তারা। এটি করতে তারা যেমন জীবনের মায়া ত্যাগ করেছেন, ঠিক তেমনি সংসার বা পরিজনদের মায়াও ত্যাগ করে প্রতিদিন ছুটে আসছেন রামেকের করোনা ল্যাবে।

করোনা ল্যাবে কাজের প্রস্তুতি নিচ্ছেন চিকিৎসকেরা

রামেক সূত্র মতে, করোনা ল্যাব প্রতিষ্ঠা করার জন্য যখন সরকার হিমশিম খাচ্ছিল ঠিক তখনোই ঢাকা ও চট্টগ্রামের পর তৃতীয় ল্যাব প্রতিষ্ঠিত করা হয় রাজশাহীতে। কিন্তু ল্যাব প্রতিষ্ঠা করলেই তো আর হবে না-এটি পরিচালনার জন্য চাই দক্ষ জনবল। তবে এই ধরনের স্পর্শকাতর ল্যাবে কাজ করতে তখন দরকার পড়ে দক্ষ চিকিৎসকের পাশাপাশি দক্ষ ল্যাব টেকনিশিয়ানদের। আর শুরুতেই সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে এ কাজে এগিয়ে আসেন অধ্যাপক বুলবুল হাসান ও অধ্যাপক সাবেরা গুল নাহার। সাবেরা গুল নাহারকে প্রধান করে ল্যাব পরিচালনার জন্য একটি দল গঠন করা হয়। যে দলের সদস্য সংখ্যা এখন ১৩ জন।

ল্যাব সূত্র মতে, পাঁচজন চিকিৎসক ও আটজন টেকনোলজিস্টের সমন্বয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের করোনা ল্যাবটি পরিচালিত হচ্ছে। এখন দিনে দুই শিফটে এ ল্যাবটি পরিচালনা করতে গিয়ে প্রতিদিনই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করতে হচ্ছে এই টিমকে। এমনকি শুক্রবারেও ছুটি পাচ্ছেন না তারা। আর এই টিমের অগ্রভাগের নেতৃত্বে থাকছেন সাবেরা গুল নাহার ও বুলবুল হাসান দম্পতি।

প্রতিদিন ২০০-৩০০ নমুনা আসছে পরীক্ষার জন্য। যা একদিন পরে সেগুলোর পরীক্ষা কাজ শুরু হচ্ছে। আবার সীমাবদ্ধতার চেয়েও অতিরিক্ত নমুনা আসায় কখনো কখনো ঢাকাতেও পাঠানো হচ্ছে পরীক্ষা করতে। কিন্তু তারপরেও থেমে নেই রাজশাহী ল্যাবে করোনা পরীক্ষা। নানা ঝড়-ঝাপটা উপেক্ষা করে প্রতিদিন এই টিমকে ছুটে আসতে হচ্ছে ল্যাবে।

অধ্যাপক ডা. বুলবুল হাসান বলেন, রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ল্যাবটি স্থাপন করা গেছে মাননীয় মেয়র এএইএম খায়রুজ্জামান লিটন ও ফজলে হোসেন বাদশা এমপির সহযোগিতায়। এই ল্যাবে কাজ শুরু করার পর একমাত্র মেয়েকেও বাড়ি থেকে সরিয়ে দিয়ে ছোট ভাইয়ের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। আমাদের মাধ্যমে সে যেন আক্রান্ত না হয় এ কারণে তাকে বাড়ি থেকে তার চাচার বাসায় রাখা হয়েছে। দেশসেবায় ব্রত নিয়ে যখন এই কাজ করে যাচ্ছি, তখন জীবনের মায়া আর আপনজনদের মায়া করে লাভ কী। দেশের মানুষের সেবা করে দেশটাকে ঠিক রাখতে পারলে একদিন আপনজনদেরও কাছে পাব হয়তো।’

বুলবুল হাসানের স্ত্রী সাবেরা গুল নাহার ল্যাব প্রধান। ফলে দায়িত্বও অনেক বেশি তার। তিনি বলেন, ‘এই কাজ করতে গিয়ে কখনো কখনো ঠিকমতো খাওয়াটাও হয় না। আগে দুপুরের খাবার খেতে হয় ল্যাবেই। এখন রোজার মধ্যে ইফতারটাও চলে ল্যাবে। কখনো কখনো রাতের খাবার হয়ও না। বাসায় গিয়ে একেবারে সাহরি রান্না করে খেতে হয়। এভাবেই চলছে। তবুও চাই দেশের মানুষের সেবা করে যেতে। দেশ করোনামুক্ত হলেই আমাদের সার্থকতা হবে। তখন শান্তি পাব।’

তিনি আরও বলেন, ‘করোনা ল্যাবে কাজ করার জন্য একমাত্র শয্যাশায়ী মাকেও এখন অন্য বোনের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। মেয়েকেও পাঠানো হয়েছে তার চাচার বাসায়। এ ছাড়াও অন্য আপনজনদের আমাদের বাসায় আসতে নিষেধ করা হয়েছে। তারপরেও আমরা স্বামী-স্ত্রী ভালো আছি এই ভেবে যে, আমরা দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সামনে থেকে কাজ করে যাচ্ছি।’


শর্টলিংকঃ