আড়ালেই ইয়াবায় ‘বিনিয়োগকারীরা’


ইউএনভি ডেস্ক:

মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযানে সাড়ে পাঁচ শ কারবারি নিহত হয়েছেন। দুই দফায় আত্মসমর্পণ করেছেন ১২৩ জন। কিন্তু দেশে ইয়াবা ট্যাবলেটের চালান আসা এবং বেচাকেনা বন্ধ হয়নি। এখনো মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে আসা ইয়াবা ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। যাঁরা ইয়াবার চালান আনছেন, অর্থাৎ বিনিয়োগকারী, তাঁরা আড়ালে থাকছেন।

তথ্য অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কক্সবাজারের শীর্ষ ৭৩ জন পৃষ্ঠপোষক ও কারবারির ৪০ জনই আত্মসমর্পণ করেননি। প্রশাসনের বিভিন্ন উদ্যোগের সুযোগ নিয়ে নিজেদের আড়ালে রেখেছেন অনেকে। আত্মসমর্পণের পরেও কারাগারে থাকা কারবারিদের সহযোগীরা সক্রিয় আছেন।

অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ২০ জন শীর্ষ কারবারিকে নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে তাঁদের শতকোটি টাকার সম্পদের তথ্য পেয়েছে। তবে দেড় বছরে মাত্র ১২ জনের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের মামলা করা হয়েছে, যার একটিরও তদন্ত শেষ হয়নি। তদন্ত করে প্রমাণ জোগাড় না হওয়ায় শীর্ষ ইয়াবা কারবারিদের অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়নি এখনো।

স্থানীয় ও গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, ইয়াবার কারবারে ‘বিনিয়োগকারীরা’ আর্থিক অনুসন্ধানের ধীরগতির সুযোগ নিয়ে টাকা-পয়সা সরিয়ে ফেলেছেন। অনেকে আত্মসমর্পণের আগেই এই কৌশল নেওয়ায় সম্পদের তথ্য পাননি তদন্তকারীরা।

ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ নিয়ে আত্মসমর্পণ করা শীর্ষ ইয়াবা কারবারিরা আদালত থেকে জামিন নিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি শীর্ষ ইয়াবা কারবারি ও সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির খালাতো ভাই মং মং সেন, আপন ভাই মোহাম্মদ সফিক, কামরুল হাসানসহ পাঁচজনের জামিন আবেদনের শুনানি গোপনে শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। কক্সবাজারের পাবলিক প্রসিকিউটর ও প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপে তাঁদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

শীর্ষ ৪০ কারবারি অধরা :

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সব সংস্থা মিলে এক লাখ ২৪ হাজার ৯৮ মামলায় এক লাখ ৬২ হাজার ৮৪৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। উদ্ধার করা হয়েছে তিন কোটি চার লাখ ৪৬ হাজার ৩২৮টি ইয়াবা। মানবাধিকার সংস্থা ও পুলিশের তথ্য মতে, ২০১৮ সালের ১৫ মে থেকে গত ৩০ জুলাই পর্যন্ত মাদকবিরোধী অভিযানে নিহত হয়েছেন ৫৮৬ জন। শুধু কক্সবাজার জেলায় পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ২৮৭ জন নিহত হন।

এদিকে পুলিশের উদ্যোগে গত বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি ১০২ জন এবং চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি ২১ জন কারবারি আত্মসমর্পণ করেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা সমন্বিত তালিকায় কক্সবাজারের ৭৩ শীর্ষ ইয়াবা গডফাদারের নাম রয়েছে। মন্ত্রণালয় গঠিত বিশেষ টাস্কফোর্স সর্বশেষ ৫৪ গডফাদারকে চিহ্নিত করে। প্রথম দফায় আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে ২৪ জনের নাম এই তালিকায় রয়েছে। তাঁদের মধ্যে আছেন টেকনাফের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির চার ভাই আবদুল আমিন, আবদুর শুক্কুর, মোহাম্মদ সফিক ও মোহাম্মদ ফয়সাল, ভাগ্নে সাহেদুর রহমান নিপু এবং বেয়াই শাহেদ কামাল।

তালিকার ২ নম্বরে থাকা টেকনাফের হাজি সাইফুল করিমসহ ৯ জন পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। দ্বিতীয় দফায় যে ২১ জন আত্মসমর্পণ করেছেন তাঁদের কেউ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত নন। তালিকার ১ নম্বরে নাম ছিল আব্দুর রহমান বদির। তিনিসহ বাকি ৪০ জন আত্মসমর্পণ করেননি। তাঁর ভাই টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর মৌলভী মুজিবুর রহমান, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদ, তাঁর ছেলে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহজাহান মিয়া, টেকনাফ জালিয়াপাড়ার জাফর আলম ওরফে টিটি জাফর, টেকনাফ উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা রফিক উদ্দীন, তাঁর ভাই বাহারছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাওলানা আজিজ উদ্দীন এবং টেকনাফ সদর ইউনিয়নের নাজিরপাড়ার নুরুল হক ভুট্টোও আত্মসমর্পণ করেননি। ছোট সারির বিক্রেতারা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হলেও চিহ্নিত গডফাদাররা ‘নিরাপদে’ থাকায় স্থানীয় লোকজনের মধ্যে বিভিন্ন গুঞ্জন চলছে।

কক্সবাজারের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম  বলেন, ‘গত ১৫ জুলাই রাষ্ট্রপক্ষের অজান্তেই কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মং মং সেন, সফিক, কামরুলসহ পাঁচ শীর্ষ ইয়াবা কারবারি গোপনে জামিন নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সফল হয়নি।’

কক্সবাজারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন কর্মকর্তা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কেনাবেচা করা কারবারিদের ধরতে পারলেও আমরা এখনো বিনিয়োগকারীদের ধরতে পারিনি। অনেকে আত্মসমর্পণ করলেও সিন্ডিকেট পরিচালনা করে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছে। আবার অনেকে পালিয়েও আছে।’

সীমান্তে দায়িত্বরত সূত্রে জানা গেছে, আত্মসমর্পণকারী কারবারি আবু তাহেরের কক্সবাজারের তারাবুনিয়ার বাড়িতে গত বছরের ২ মে অভিযান চালিয়ে ৬০ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট পাওয়া যায়। ওই সময় তাঁর পরিবারের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। আত্মসমর্পণকারীদের সিন্ডিকেট সক্রিয় থাকার এমন অনেক তথ্য পাওয়া গেছে বলে সূত্র জানায়।

তাঁদের কোটি টাকার সম্পদ :

সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, ইয়াবা কারবার করে অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত এবং কারবারিদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার ঘোষণা দেওয়া হয় গত বছর। এ ছাড়া তাঁদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করে তদন্তের কথাও বলা হয়। ওই সময় ২০ কারবারির ব্যাপারে অনুসন্ধান করার জন্য সিআইডির সংঘবদ্ধ অপরাধ শাখার ১০ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এক বছর পর গত ২১ মার্চ ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। সিআইডির তদন্তে কিছু কারবারির শতকোটি টাকার সম্পদের তথ্য মিলেছে। তবে অনেক কারবারির সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়নি।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার বা আত্মসমর্পণের আগে ‘সুযোগ পেয়ে’ বেশ কিছু কারবারি তাঁদের টাকা-পয়সা সরিয়ে ফেলেছে। অনেকে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণেও বিভিন্ন জায়গায় দৌড়ঝাঁপ করছেন।

যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে তাঁরা হলেন আবদুস শুকুর, আমিনুর রহমান, শফিকুল ইসলাম শফিক, ফয়সাল রহমান, একরাম হোসেন, নুরুল কবির, জামাল মেম্বার, মোহাম্মদ আলী, নুরুল হুদা মেম্বার, আবদুর রহমান, শাহ আজম ও এনামুল হক এনাম মেম্বার।

সিআইডির অনুসন্ধানে ইয়াবার টাকায় আবদুস শুকুর এক কোটি ৩০ লাখ টাকার সম্পদ কিনেছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। নুরুল কবিরের ১৯টি জমির তথ্য মিলেছে, যার মূল্য কমপক্ষে তিন কোটি ৫১ লাখ ১৮ হাজার টাকা। একরাম হোসেনের প্রায় ৭০ লাখ টাকা মূল্যের জমির সন্ধান মিলেছে। জামাল মেম্বারের ৮০ শতাংশ জমি পাওয়া গেছে, যার মূল্য ১৯ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। ইয়াবার টাকায় মোহাম্মদ আলীর প্রায় এক একর জমি ও বিলাসবহুল গাড়ি হয়েছে। নুরুল হুদা মেম্বারের ৮২ লাখ টাকার জমি এবং আরো কিছু সম্পদের খোঁজ মিলেছে। আব্দুর রহমানের জমি আছে কমপক্ষে ৪৩ লাখ টাকার।

অবশ্য আমিনুর রহমান, শফিকুল ইসলাম শফিক, শাহ আজম, ফয়সাল রহমান ও এনামুল হক এনামের ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেন এবং কিছু সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। তবে প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রমাণ পায়নি সিআইডি।

জানতে চাইলে সিআইডির সংঘবদ্ধ অপরাধ শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস) মোস্তফা কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মানি লন্ডারিংয়ের মামলা দায়ের করতে হলে আগে অনুসন্ধান করে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করতে হয়। এ কারণে প্রথমে আমরা কয়েকটি মামলা করে সেগুলোর তদন্ত করছি। করোনা পরিস্থিতির কারণে আর অগ্রগতি হয়নি।’


শর্টলিংকঃ