ইজতেমা ফিরে আসুক স্বমহিমায়


আহমাদ জামিল:

বিশ্ব ইজতেমা

বিশ্ব ইজতেমার জন্য তুরাগ পরিচিত বিশ্বব্যাপী। কহরদরিয়াখ্যাত এ নদীর তীরেই গত ৫০ বছর হচ্ছে বিশ্ব ইজতেমা। ইজতেমা মানে একত্রিত হওয়া, জমা হওয়া। ইমানি চেতনা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার প্রত্যয়ে তুরাগতীরে লাখো মুসলমান একত্রিত হতেন, এক হয়ে চোখের পানি ঝরাতেন। কত ইতিহাসের সাক্ষী টঙ্গীর এ ময়দান। প্রতিবছর জানুয়ারির এ সময়ে তুরাগতীরে জমে উঠত প্রাণের এ মেলা।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা হাজারো মানুষের পদভারে মুখরিত থাকত টঙ্গীর অলিগলি। ‘জিকিরে ফিকিরে চলি, যার যার ডানে চলি’ মধুমাখা এ আহ্বানে পথচলত সবাই। কিন্তু হায়! এবারও জানুয়ারি এসেছে। কিন্তু জমেনি ইমানের এ আসর। বাশের খুঁটি আর চটের ছালা এলোমেলোভাবে পড়ে আছে ময়দানজুড়ে। খালি মাঠ এখন খা খা করছে, নেই দরদি দিলের আহ্বায়করা। এ মাঠে এখন লেগে আছে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। ময়দানের মাটিতে ভাইয়ের হাতে রঞ্জিত হয়েছে আরেক ভাই।

না, কোনো শত্রুপক্ষের আক্রমণ নয়, টঙ্গীর পবিত্র এ মাটিতে লড়াই হয়েছে নিজেদের মধ্যেই। দ্বীন কায়েমের মহান উদ্দেশ্যে নয়, ইজতেমা মাঠের দখল নিয়ে লড়াই করেছে দ্বীনের দায়ীরা। হায়, এমন ঘটনাও আমাদের দেখতে হল। যখন টঙ্গীর পবিত্র এ ময়দানে লাঠি হাতে তাবলিগের সাথী ভাইয়েরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করছিল, সাধারণ মানুষ শুধু অবাক বা বিস্মিত নয়, হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল।

মানুষ বিশ্বাস করতে পারছিল না, কারা এমন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। এরা কি সেই পবিত্র জামাতের মানুষ, যারা মানুষকে আহ্বান করত সত্য ও সুন্দরের পথে? পাড়ার বখাটে ছেলেদের আড্ডা থেকে যারা উঠিয়ে নিত মসজিদে। পরিবারের অবাধ্য সন্তানকে যখন নিয়ন্ত্রণ করাটা কঠিন হয়ে পড়ে, তখনই অভিভাবকরা তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে তাবলিগে পাঠাতেন। হায়, মানুষ সংশোধনের মেহনতকারীরাই কি লড়াই বাধাল একে অন্যের বিরুদ্ধে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে সাধারণ মানুষের।

আমি অনেক ভেবেছি, দুই পক্ষের বড় বড় দায়িত্বশীলদের সঙ্গেও বিস্তারিত কথা বলেছি, মূলত এ লড়াইটা কিসের তা জানার জন্য, দ্বীনের নামে হলেও এ লড়াইয়ে আধিপত্য বিস্তারের, তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না। টঙ্গী ময়দানে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে যে দু’জন নিহত হয়েছেন, আমি তাদের পরিবারেরও খবর নিয়েছি। কোনো মুরব্বি খোঁজ নিতে তাদের বাড়ি যায়নি। নিহত ইসমাইল মণ্ডল ও শামসুদ্দিন বেলালের সন্তানদের পাশে দাঁড়ায়নি তাবলিগের কোনো মুরব্বি। বরং এ দু’জনের লাশ নিয়েও দলাদলি হয়েছে।

উভয়পক্ষই দাবি করেছে নিহতরা তাদের দলের লোক। মানবতার চেয়ে সাম্প্রদায়িকতা যখন বেশি প্রাধান্য পায়, তখনই হয়তো এমন আচরণ সম্ভব হয় মানুষের পক্ষে। নিহত শামসুদ্দীন বেলাল তাবলিগের কোনো পক্ষের ছিল, সাংবাদিকরা এমন প্রশ্ন করলে তার স্বজনরা জানিয়েছে, তাবলিগে যে দুটি পক্ষ আছে, তারা এটি জেনেছে শামসুদ্দীন নিহত হওয়ার পর। নোয়াখালী থেকে শুধু আল্লাহর দ্বীনের পথে সময় লাগানোর জন্যই তিনি ঢাকায় এসেছিলেন।

মর্মান্তিক এ কথাগুলো শুনে ভাবি, হায়, কোথায় এ জামাতের ইকরামুল মুসলিমিন, কোথায় সহিহ নিয়ত, আর কোথায় গেল সে তাবলিগ। যে তাবলিগের প্রতি আস্থা ছিল সাধারণ মুসলমানদের, ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, দেশি-বিদেশি সবাই যেখানে এককাতারে চলত, তাবলিগে গিয়ে একই বাসনে খাবার খেত যারা, তারা আজ নিজেদেরই সহ্য করছে না। পরস্পর সালাম বিনিময় বন্ধ। হায়, এ কেমন কথা। এটা কি ইসলামের শিক্ষা? তাবলিগি ভাইদের প্রতি সবার এখন একটাই আশা, তারা পরস্পর হানাহানি বন্ধ করে ঝগড়া ফাসাদ এড়িয়ে চলবেন।

তাবলিগ করা যতটুকু গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে শতগুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল বিবাদ এড়িয়ে শান্তির পথে চলা। কিয়ামতের ময়দানে আল্লাহতায়ালা এ কথা জানতে চাইবেন না যে, তুমি কোন পক্ষের হয়ে তাবলিগ করেছ? তবে এ জন্য অবশ্যই জবাবদিহিতা চাইবেন যে, তুমি অমুককে কেন কষ্ট দিয়েছ। কেন অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছ। কেন অশান্তি সৃষ্টি করেছ সমাজে। প্রিয় তাবলিগি মুরব্বি ও সাথী ভাইয়েরা, আপনারা নিজেদের স্বার্থে গত প্রায় ১০০ বছরে গড়ে উঠা এ মেহনতের ভাবমূর্তিটুকু ক্ষুণ্ণ করবেন না।

তাবলিগ জামাতকে মানুষ শান্তিকামী দল হিসেবেই বিবেচনা করে, মানুষের আস্থার জায়গাটা যেন আপনাদের কার্যকলাপে নষ্ট না হয়, বিষয়টি আপনাদেরই লক্ষ্য রাখতে হবে। একটু ভেবে দেখুন, আপনাদের এসব কর্মকাণ্ডে হজরতজি ইলিয়াস (রহ.), ইউসুফ (রহ.), এনামুল হাসানসহ (রহ.) বিগত মুরব্বিরা কেমন কষ্ট পাচ্ছেন। তারা যদি কিয়ামতের ময়দানে আল্লাহর কাছে এর বিচার চান, আপনারা কী জবাব দিতে পারবেন? এ উপলব্ধিটুকুর বড় প্রয়োজন আজ।

মনে পড়ে মূর্খ সেই মেওয়াতির কথা, একদিন নিজামুদ্দীনের মিম্বারে ২য় হজরতজি ইউসুফ (রহ.) হঠাৎ ঘোষণা দিলেন, আজ থেকে তাবলিগের এ মেহনত বন্ধ। আপনারা সবাই নিজ নিজ কাজে লেগে যান। এখন থেকে আর মেহনত চলবে না। সবাই নীরব, বিস্মিত। কেউ বুঝতে পারছেন না হঠাৎ কী হল? কেন এমন ঘোষণা দেয়া হল। পেছন থেকে এক মূর্খ মেওয়াতি দাঁড়িয়ে হজরতজিকে সম্বোধন করে বললেন, ইউসুফ শোন, আমরা তোমার তাবলিগও করি না, তোমার বাবার তাবলিগও করি না। দাওয়াতের মেহনত আমাদের সবার দায়িত্ব।

তাই আমরা এ মেহনত করি। তুমি চলে যাও, কোনো সমস্যা নেই। আমরা মেহনত চালিয়ে যাব। বৃদ্ধ মেওয়াতির এমন কথা শুনে সবারই সম্বিত ফিরে এলো। হজরতজি খুশি হয়ে বললেন, এমন কথা শোনার অপেক্ষায় ছিলাম আমি। আলহামদুলিল্লাহ, উম্মত নিজের দায়িত্ব বুঝতে পেরেছে। আজ সময় হয়েছে একই কথা বলার। তাবলিগের দুই পক্ষের মুরব্বিরা সাধারণ সাথীদের দুই দিকে ডাকছে।

সাদাসিধে মানুষ বড়ই পেরেশান। নিজ দলের প্রতি আহ্বান করলে এখন তাবলিগি সাথী ভাইদের উচিত মুরব্বিদের জানিয়ে দেয়া, আপনারা আপনাদের বিবাদ নিয়ে থাকুন। আমরা আপনাদের এসব বিবাদে নেই। আমরা দ্বীনের জন্য সবাই মিলেমিশে তাবলিগ করি, কোনো মুরব্বির জন্য নয়।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও তাবলিগি সাথী


শর্টলিংকঃ