উচ্ছেদ নোটিশে ‘বৈধ মালিক’দের আপত্তি


কাজী কামাল হোসেন,নওগাঁ
নওগাঁর মান্দা উপজেলার সতিহাট বাজারে খালের জমিতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ৫০ জন ব্যক্তিকে নোটিশ দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো)। আজ সোমবারের (২৩ ডিসেম্বর) মধ্যে এসব স্থাপনা সরিয়ে না নিলে তা ভেঙ্গে ফেলা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।


তবে উচ্ছেদ নোটিস পাওয়া ব্যক্তিদের অভিযোগ, মূল নকশা না মেনে বিতর্কিত নকশা দিয়ে জরিপ চালিয়ে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি থেকে উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে পাউবো। বিতর্কিত নকশা দিয়ে জরিপ করায় খাল পাড়ে দোকানপাট ও বসতঘর নির্মাণকারী অনেকের ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পতি খালের জমি বলে দেখানো হয়েছে। সঠিক নকশা অনুযায়ী পুনরায় জরিপ চালিয়ে এবং সরেজমিনে তদন্ত করে উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করার দাবি জানিয়ে গত বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসক বরাবর এলাকাবাসীর পক্ষে হেলার হোসেন নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি লিখিত আবেদন জানান।

লিখিত ওই আবেদন সূত্রে জানা যায়, মান্দা উপজেলার পাঠাকাঠা এলাকায় আত্রাই নদ থেকে উৎপত্তি ওই খালটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১০ কিলোমিটার। খালটি শেষ নওগাঁ সদর উপজেলার হাসাইগাড়ী বিলে গিয়ে। ১৯৮৮-৮৯ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি জরিপ চালিয়ে খালের খালের উভয় পাড়ের জমি চিহ্নিত করে এবং খালের সম্প্রসারণের জন্য সতিহাট বাজার এলাকায় স্থানীয় ব্যক্তিদের কাছ থেকে কিছু জমি হুকুমদখল (অধিগ্রহণ) করে খাস খতিয়ানভুক্ত করা হয়।

খালটির উভয় পাশে উপজেলার অন্যতম বড় হাট সতিহাট বাজার অবস্থিত। সতিহাট বাজারে প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকাজুড়ে খালটির উভয় পাশে শতাধিক স্থাপনা রয়েছে। সম্প্রতি একটি বিতর্কিত নকশা যার দাগ ও খতিয়ান সম্পষ্ট নয়- এমন একটি নকশা অনুযায়ী জরিপ চালিয়ে উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে পাউবো কর্তৃপক্ষ। খালটির পশ্চিম-উত্তর পাড় খাস জমি অন্যের নামে লিজ (বন্দোবস্ত) বরাদ্দ দিয়ে অপর পাড়ে (দক্ষিণ-পূর্ব) ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে দোকান-পাট ও বাড়ি নির্মাণকারীদের নোটিস দেওয়া হয়েছে। অথচ খালের পশ্চিম-উত্তর পাড়ে অবৈধভাবে খাস জমি দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করেছেন এমন ব্যক্তিদের কোনো নোটিস দেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে অভিযোগকারী হেলাল হোসেন বলেন, ‘১৯৮৮-৮৯ সালে যে নকশা অনুযায়ী জরিপ চালিয়ে খালের জমি উদ্ধার ও খাল সম্প্রসারণের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয় সেই নকশা অনুসরণ করা হচ্ছে না। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রশাসনের কিছু অসৎ কর্মকর্তা উচ্ছেদের নামে বাণিজ্য করার জন্য দাগ ও খতিয়ান স্পষ্ট নয় এমনটি বিতর্কিত নকশা দিয়ে জরিপ করে উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে। জরিপের সময় অভিযেগ করার পরও ওই নকশা দিয়ে জরিপ চালিয়ে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি খাস খতিয়ানভুক্ত দেখানো হয়েছে। এর ফলে নিরীহ ব্যক্তির মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ভোগদখল করা সম্পতি বেদখল হয়ে যাবে। এটা খুবই অমানবিক।’

ফারুক হোসেন নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘খালের দক্ষিণ-পূর্ব পাড়ে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে তিনটি আধাপাকা দোকানঘর রয়েছে। বাপ-দাদার আমল থেকে ওই জমি আমরা ওই জমি ভোগ-দখল করে আসছি। নব্বইয়ে দশকে ওই জমি থেকে কিছু জমি খালের জন্য অধিগ্রহণ করে সরকার। অধিগ্রহণ করা জমি বাদ দিয়ে খাজনা-খারিজ জমিতে আমার দোকানঘর। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে আমার ওই দোকানঘরগুলোও নাকি খালের জমি। এই জমি চলে গেলে আমি নিঃস্ব হয়ে যাব।’
তিনি আরও বলেন, ‘তড়িঘড়ি নোটিসে এই উচ্ছেদ কার্যক্রম চালাতে যাচ্ছে পাউবো। ২৩ ডিসেম্বরের মধ্যে স্থাপনা সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। কিন্তু আমি নোটিস পেয়েছি গত বুধবার। নোটিসে সাক্ষর রয়েছে ১২ ডিসেম্বরের অথচ আমাকে নোটিস দেওয়া হয়েছে বুধবার। অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য এই তড়িঘড়ি করা হচ্ছে বলে আমার ধারণা।’

আব্দুস সামাদ নামে আরেক ব্যক্তির অভিযোগ, ‘প্রশাসনের কিছু অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী কিছু মানুষ যাঁরা প্রকৃতপক্ষে অবৈধ দখলদার তাঁদের কাছ থেকে টাকা খেয়ে ওই সব সম্পত্তি উদ্ধার না করে বিতর্কিত নকশা নিয়ে এসে নিরীহ মানুষের সম্পত্তি খালের নামে দখল করে নিচ্ছে। এতে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিও জড়িত রয়েছে। সঠিক তদন্ত হলে এ কার্যক্রমে জড়িত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাম বেরিয়ে আসবে। আমরা অবৈধ দখল উচ্ছেদের বিরুদ্ধে নয়, কিন্তু আমাদের দাবি, সঠিক নকশা মেনে খালের উভয় পাশে প্রকৃতপক্ষে যেসব অবৈধভাবে দখল করা হয়েছে সেগুলো উদ্ধার করা হোক।’

এ ব্যাপারে নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুধাংশু কুমার সরকার বলেন, ‘জেলা প্রশাসন থেকে নকশা দিয়ে জরিপ চালিয়ে খালের জমি অবৈধভাবে দখল করে স্থাপনা নির্মাণকারী দখলদারদের নোটিস দেওয়া হয়েছে। এখানে আমাদের কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নেই। আর হঠাৎ করে দেওয়া হচ্ছে, এই অভিযোগও সঠিক নয়। গত ২৫ নভেম্বর দখলদারদের নোটিস দেওয়া হচ্ছে। অনেকের কাছে নোটিস পৌঁছাতে হয়তো দেরি হচ্ছে।’

আবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) উত্তম কুমার রায় বলেন, ‘খালের জমি বলে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি নিয়ে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিজস্ব সার্ভেয়ার ও মান্দা উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার দিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের নকশা অনুযায়ী জরিপ চালানো হচ্ছে। পানি প্রবাহ সঠিক রাখতে খালের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে পরবর্তীতে ওই সব জমি অবৈধভাবে দখল হয়েছে শুধুমাত্র সেই জমি দখলমুক্ত করা হবে। শুধুমাত্র ওই খাল নয়, পর্যায়ক্রমে নওগাঁর সকল নদী ও খাল দখলমুক্ত করা হবে।’


শর্টলিংকঃ