করোনায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে হঠাৎ জেগে ওঠা


২০১৭-১৮ অর্থবছরে সড়ক নির্মাণ ও রক্ষনাবেক্ষণের বাজেট ছিলো ১৫ হাজার কোটি টাকা,এরমধ্যে কত টাকা লুটপাট হয়েছে এটা সারাদেশের সড়কগুলোর এক্সরে করলেই বোঝা যাবে।পরিবহন খাতে প্রতিমাসে প্রায় ২,০০০ কোটি টাকা চাঁদা আদায় হয় যা দিয়ে ৪৫ লাখ পরিবহন শ্রমিককে ১৫ বস্তা করে চাল দেওয়া সম্ভব।বর্তমানে ট্রেনের একটি  টিকিট যোগাড় করতে এমপি-মন্ত্রীর সুপারিশ লাগে এবং ট্রেনে কোন সিট ফাঁকা না থাকলেও শুধু ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রেলের লোকসান দেখানো হয়েছে ১,৮৫২ কোটি টাকা। যা দিয়ে কেনা যাবে ৬ কোটি বস্তা চাল এবং এই চাল চুরি করতে ৪৯২ জন উপজেলা চেয়ারম্যানের কমপক্ষে ৩৫ বছর লাগার কথা।

ইউরোপ,আমেরিকা যখন করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত,আইসিইউ এবং ভেন্টিলেটর প্রস্তুত করতে হিমশিম খাচ্ছে; তখন বাংলাদেশে করোনা চিকিৎসার চেয়ে চাল চুরি নিয়ে যেভাবে হৈচৈ হচ্ছে তাতে মনে হতে পারে বাংলাদেশ একটি দুর্নীতিমুক্ত দেশ এবং এদেশের সাধারন মানুষ কখনই দুর্নীতি সহ্য করতে পারেনা।কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের হ্যাট্রিক করারও রেকর্ড আছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়াতো দূরের কথা বিগত ৫০ বছর ধরে এদেশের সাধারন মানুষ অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দে দুর্নীতির সাথে বসবাস করে,খায়,ঘুমায়,লুডু খেলে,গল্প করে,সিনেমা দেখে….। প্রতিদিন সাগর চুরি দেখতে অভ্যস্ত বাঙালি হঠাৎ কয়েক বালতি পানি চুরি নিয়ে কেন এতো হৈহৈ রৈরৈ করছে,সেটাই আজ মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন।

শিক্ষাবোর্ড,ডিজি অফিস সর্বত্র দুর্নীতির আখড়া। বিশ্ববিদ্যালয়ে টাকার বিনিময়ে অযোগ্য,মেধাহীন শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে হাজারো মেধাবীর স্বপ্ন চুরি হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের একজন প্রকল্প পরিচালক স্কুলের জমি অধিগ্রহনের জন্য প্রতিটা কলা গাছ ৬ লাখ,প্রতিটা নারিকেল গাছ ৬৩ লাখ এবং একটি ছাপরা ক্রয় করেছেন ৬ কোটি টাকায়।এদেশের ইন্জিনিয়ার যখন ভবনে রডের বদলে বাঁশ দেয়, একটা বালিশ শুধু ভবনের নিচ থেকে উপরে উঠানোর জন্য হাজার হাজার টাকা খরচ দেখায়,তখন বিয়ের পাত্র হিসেবে ইন্জিনিয়ার সাহেবের চাহিদা আরও বেড়ে যায়।চিন্তা করুন একটা নারিকেল গাছের দামে ৮০ হাজার লিটার তেল,একটা ছাপরার টাকা দিয়ে ৬০ লাখ কেজি চাল এবং রুপপুরের শুধুমাত্র একটা বালিশের টাকা দিয়ে ১০০ কেজি ডাল পাওয়া যাবে।

বেসরকারি হাসপাতালগুলো কমিশনখোরদের আঁতাতে অপ্রয়োজনীয় টেষ্ট করে জনগনের যত টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তা দিয়ে বছরে কয়েক লাখ ভেন্টিলেটর কেনা সম্ভব; ঔষধ কোম্পানিগুলো পছন্দ অনুযায়ী প্রেসক্রিপশন লেখানোর জন্য যত টাকার উপহার দেয় তা দিয়ে কয়েক কোটি পিপিই আর এন৯৫ মাস্ক কেনা যাবে; প্রতিবছর সরকারি হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনায় যে লুটপাট হয় তা দিয়ে প্রত্যেক জেলায় ৫,০০০ বেডের করোনা হাসপাতাল বানানো সম্ভব; শুধুমাত্র স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারি আফজাল হোসেনের দুর্নীতির টাকা দিয়ে করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত ডাক্তার,নার্সদের কয়েক বছর ফাইভ স্টার হোটেলে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা সম্ভব।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে সড়ক নির্মাণ ও রক্ষনাবেক্ষণের বাজেট ছিলো ১৫ হাজার কোটি টাকা,এরমধ্যে কত টাকা লুটপাট হয়েছে এটা সারাদেশের সড়কগুলোর এক্সরে করলেই বোঝা যাবে।পরিবহন খাতে প্রতিমাসে প্রায় ২,০০০ কোটি টাকা চাঁদা আদায় হয় যা দিয়ে ৪৫ লাখ পরিবহন শ্রমিককে ১৫ বস্তা করে চাল দেওয়া সম্ভব।বর্তমানে ট্রেনের একটি  টিকিট যোগাড় করতে এমপি-মন্ত্রীর সুপারিশ লাগে এবং ট্রেনে কোন সিট ফাঁকা না থাকলেও শুধু ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রেলের লোকসান দেখানো হয়েছে ১,৮৫২ কোটি টাকা। যা দিয়ে কেনা যাবে ৬ কোটি বস্তা চাল এবং এই চাল চুরি করতে ৪৯২ জন উপজেলা চেয়ারম্যানের কমপক্ষে ৩৫ বছর লাগার কথা।

বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোষাক রপ্তানীকারক দেশ,বছরে কয়েক লাখ কোটি টাকার পোষাক রফতানি হয়,সরকার নানা সময়ে কারনে অকারনে হাজার হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দেয়;কিন্তু যাদের শ্রমে-ঘামে মালিকরা ইগড গাড়িতে চড়েন আর আমেরিকায় সেকেন্ড হোম বানায় সেই অসহায় নারীরা বছরের পর বছর বেতন বোনাসের দাবিতে আন্দোলন করছে; অথচ বাংলাদেশের ৩,৭০০ গার্মেন্টসের মাত্র ১০ ভাগ মালিক যদি একটা বছর গাড়ির মডেল বদল না করে এবং একটা ঈদ সিঙ্গাপুরে শপিং না করে,তাহলে ৪০ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিকের অন্তত ১ বছরের খাবার চাহিদা মেটানো সম্ভব। তাজরীন ফ্যাশনস এর ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে পুড়ে কয়লা হওয়া কর্মির এতিম বাচ্চাটার দুমুঠো ভাত অথবা রানা প্লাজা ধসে আজীবনের জন্য পঙ্গু হওয়া মেয়েটির ওষুধের জন্য আপনি কি কখনও রক্তচোষা ওই গার্মেন্টস মালিকদের ছবি ফেসবুকে ভাইরাল করে বলেছেন ” ফাঁসি চাই”?

শেয়ারবাজার থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা গায়েব হয়ে গেলো; নতুন নতুন ব্যাংক খুলে এর পরিচালকেরা নামে বেনামে নিজেরাই লোন নিয়ে ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া বানাচ্ছে; মাত্র ২০ জন শীর্ষ ঋণখেলাপির কাছে পাওনা ৩২ হাজার কোটি টাকা; একসময়ের গার্মেন্টস কর্মী হলমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান সোনালী ব্যাংক থেকে লুট করা ৪ হাজার কোটি এবং বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যানের লোপাট করা সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা দিয়ে ৭৫০ কোটি কেজি বা ২৫০ কোটি বস্তা চাল কেনা যাবে; যদি বাংলাদেশের ৪,৫০০ জন ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সবাই চোর হয় এবং প্রত্যেক চেয়ারম্যান প্রতিদিন ১০ বস্তা করে চাল চুরি করে তবুও মোট ৫,৫৫,৫৫৫ দিন বা ১,৮৫০ মাস বা ১৫৪ বছর ধরে চুরি করতে হবে।

ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে জনগন এবং সরকারকে জিম্মি করে ইচ্ছেমত পণ্যের দাম বাড়ায়;রোদে পুড়ে,বৃষ্টিতে ভিজে ফসল ফলানো কৃষক অনাহারে থাকে অথচ শহরে সেই ফসল ২০ গুণ দামে বিক্রি হয়; কোন কারন ছাড়াই ৩০ টাকার পেয়াজ হয়ে যায় ৩০০ টাকা; বাজারে পণ্যের পর্যাপ্ত যোগান থাকা সত্বেও রমজান মাসে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম হয় আকাশছোঁয়া।

বাংলাদেশে প্রতিবছর শুধু ইয়াবা বিক্রি থেকে মাদকসম্রাটদের আয় হয় ৬ হাজার কোটি টাকা।আপনি ইউটিউবে যে আলোচিত নেত্রীর সুইমিংপুলে গোসলের ভিডিও খোঁজ করেন সেই পাপিয়া প্রতিদিন আড়াই লাখ টাকা মদের বিল দিতো,যার একমাসের মদের বিল দিয়ে ১ হাজার পরিবার ৩ মাস চলতে পারবে। ক্লাবগুলোকে জুয়ার আখড়া বানানো ক্যাসিনোর একমাসের টাকা দিয়ে দুস্থ্য খেলোয়াররা কমপক্ষে এক বছর সংসার চালাতে পারবে; জিকে শামীম বিভিন্ন দপ্তরে যত টাকা শুধু ঘুষ দিয়েছে তত টাকা চুরি করতে দেশের সকল চেয়ারম্যানের কমপক্ষে ৫০ বছর লেগে যাবে।

স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে সরকারি কর্মকর্তা,আমলা,এমপি,মন্ত্রীরা অভিজ্ঞতা অর্জন ও সরজমিনে পুকুর খনন দেখার নামে,পরিবারের চাকরবাকরসহ অপ্রয়োজনে বিদেশ ভ্রমণ করে যত টাকা অপচয় করেছে ,সেই টাকা দিয়ে দেশের প্রত্যেক গ্রামে একটা করে আধুনিকমানের হাসপাতাল বানানো যেতো ,যেটা দেখতে বিদেশীরাই এদেশে আসতো।

আপনি জমি রেজিষ্ট্রি ,বাড়ির প্ল্যান পাস ,গ্যাসের সংযোগ,ট্রেড লাইসেন্স , বদলি,প্রমোশন সকল কাজে আনন্দচিত্তে ঘুষ দেন।রাজউকের একজন সাধারন পিয়ন ঢাকা শহরে একাধিক বাড়ি,গাড়ির মালিক; সিটি কর্পোরেশনের ময়লার ট্রাকের ড্রাইভার পাজেরো গাড়িতে চড়েন; তিতাস গ্যাসের একজন সাধারন মিটার রিডার ২২ হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে যান; বনের রাজা ওসমান গনির বাসার চালের ড্রাম,বালিশ আর তোষকের ভেতরে টাকার বান্ডিল পাওয়া যায়; সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টা ত্রাণের ঢেউটিন চুরি করে;একজন সাবেক যুবরাজের মধ্যবিত্ত বন্ধু ব্যাংক,টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক হয়ে দেশে-বিদেশে টাকার পাহাড় গড়ে তোলে।

দেশের রাজনীতি আজ মৌসুমী ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি।ভূমিদস্যু,বালু ব্যবসায়ী,অটো ড্রাইভার,ট্রাকের হেলপার,মাদক ব্যবসায়ী,অস্ত্র চোরাচালানি,মুরগী চোর ,গম চোর, বিল খেলাপি,ঋণ খেলাপি, আমলা,কামলা,ইসি থেকে শুরু করে ভিসি এমনকি যাকে নিজ গ্রামে ১০০ লোক চিনেনা সেও রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য এমপি নমিনেশন চায়; এবং ঘুনেধরা জীর্ণ রাজনীতির আশির্বাদে জনপ্রতিনিধি হয়ে অনেক বাস্তুহারা আজ সুরম্য রাজপ্রাসাদে ঘুমায়,ভূমিহীন আজ এলাকার বড় জমিদার,রিক্সার যাত্রী এখন পাজেরো গাড়িতে চড়ে,কম্পিউটার অপারেটর শত কোটি টাকার মালিক;এসব দেখে মনে হবে আঙুল ফুলে কলাগাছ নয় যেন বটগাছ হয়ে গেছে। আর ভোটের সময় ওই “হঠাৎ নেতা”র ছবি গলায় ঝুলিয়ে আপনি নেতার গুণগানে চায়ের কাপে ঝড় তোলেন এবং ‘ফেয়ার এন্ড লাভলি’র রং ফর্সা করা বিজ্ঞাপনের মতো মিছিলে শ্লোগান ধরেন ”অমুক ভাইয়ের চরিত্র,ফুলের মতো পবিত্র”।

আপনি সাধারন বাঙালি আজ অদ্ভুত দ্বিমুখী আচরন করছেন।মেম্বারের খাটের নিচ থেকে তেলের বোতল উদ্ধার হলে ফাঁসির দাবি করেন অথচ আলমারি ভর্তি ক্যাসিনোর টাকা পেলেও আপনি নির্বাক থাকেন; চেয়ারম্যান এক কেজি চাল কম দিলে তার গুষ্ঠি উদ্ধার করেন অথচ বিদেশী অতিথিদের মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা ক্রেষ্টের সোনা ষোল আনা গায়েব করে দিলেও আপনি নিশ্চুপ থাকেন;আপনি ডাক্তারদের কসাই বলে গালি দিচ্ছেন অথচ নিজের সন্তানকে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন কিনে হলেও ডাক্তার বানাতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন; আপনি সারাদিন পুলিশকে ঘুষখোর বলে গালি দেন অথচ নিজে জমি বিক্রি করে ছেলের জন্য ভালো ঘুষওয়ালা চাকরি এবং মেয়ের বিয়ের জন্য হারিকেন জ্বালিয়ে ঘুষখোর জামাই খোঁজ করেন।

সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে আপনি চাল চুরির জন্য চেয়ারম্যানের ক্রসফায়ার চাচ্ছেন অথচ যেসব মহান নেতা টাকার বিনিময়ে এইসব চোর,লুটেরাদের নমিনেশন দিয়ে চেয়ারম্যান বানিয়েছেন কখনও তাঁদের বিচার দাবি করেন না বরং তাঁদের সাথে একটা সেলফি তোলার জন্য আপনি রোদ,ঝড়,বৃষ্টিতে ঘন্টার পর ঘন্টা এয়ারপোর্ট,রেলস্টেশনে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন।

স্বাধীন দেশে বিগত ৫০ বছর ধরে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় চলা লুটপাট আপনি সানন্দে গলাধ্য করেছেন। অসৎ এমপি,মন্ত্রী,আমলা,মাদকসম্রাট,ভূমিদস্যু,গার্মেন্টস মালিক,ঋণখেলাপি,ব্যাংক লুটেরাদের ভয়ে সারাজীবন কেঁচো হয়ে থাকলেও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সবচেয়ে নিচের তলার নখদন্তহীন মেম্বার,চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আপনি সাহস দেখিয়ে মানুষের মতো আচরণ করছেন তার জন্য ইতিহাসে আপনার নাম বুদ্ধিজীবির তালিকায় স্থান পাবে।

আপনার মনুষত্বের এই হঠাৎ জেগে ওঠা দেখে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক আগে ” ঝড়ের পরে” রচনায় লিখেছিলেন:
“ সবাই অবাক,সবাই ভাবে ব্যাপারখানা কি?
ভয় কাতুরে মাহবুব আজ এমন সাহসী।
তাঁকে কেঁচোই বলা যত,
রাতারাতি মানুষ হলো সে?”

উজ্জল হোসেন : সহকারী অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


শর্টলিংকঃ