চাহিদা ও বরাদ্দের ফারাক ৪১ হাজার কোটি টাকা


ইউএনভি ডেস্ক:

আগামী অর্থবছরের বাজেটে উন্নয়ন খাতে চাহিদা ও বরাদ্দের মধ্যে ফারাক থাকছে ৪১ হাজার ৪৪৯ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর চাহিদা ছিল ২ লাখ ৬৬ হাজার ৭৭৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।


অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয় ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি ১৪ লাখ টাকা। চাহিদা ও বরাদ্দের এই ঘাটতি নিয়েই আগামী ৩ জুন জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হচ্ছে ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)।

যদিও ইতোমধ্যে এটির খসড়া অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি)। কিন্তু জাতীয় বাজেটের সঙ্গে চূড়ান্ত অনুমোদন দেবে জাতীয় সংসদ।

অর্থায়নে এই ফারাকের ফলে অনেক প্রকল্পই প্রয়োজনমতো বরাদ্দ পাবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।তাদের মতে, সম্পদের সীমাবদ্ধতা এবং চলমান করোনা মহামারির কারণে চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ না-দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপরই নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

কেননা, প্রকল্প বিলম্বিত হওয়ার যে কয়েকটি কারণ তার মধ্যে অন্যতম হলো প্রয়োজন অনুসারে অর্থ বরাদ্দের অভাব।এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা বিভাগের সচিব মোহাম্মদ জয়নুল বারী রোববার যুগান্তরকে বলেন, মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর যে চাহিদা ছিল তার পুরোটাই বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হয়নি।

সরকারের সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে। সেইসঙ্গে যারা বরাদ্দ চায় তাদের বাস্তবায়নের সক্ষমতাও ঠিকঠাক থাকে না।এডিপির আওতায় প্রতিবছর যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা কমিয়ে সংশোধিত এডিপি তৈরি হয়। সেই বরাদ্দও শতভাগ খরচ হয় না।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ না-পাওয়ায় মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো যা করে তা হচ্ছে, যেসব প্রকল্প আগামী অর্থবছরে সমাপ্তের জন্য নির্ধারণ করা, সেগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ দেয়।

এ ছাড়া ফাস্টট্র্যাকভুক্ত মেগা প্রকল্প এবং তাদের মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোতে প্রয়োজনমতো বরাদ্দ দেয়। যেসব প্রকল্পের মেয়াদ অনেক বেশি থাকে সেগুলো কম বরাদ্দ রাখে।

সেগুলোতে আবার পরের অর্থবছরের এডিপিতে প্রয়োজনমতো বরাদ্দ নিশ্চিত করে থাকে। এখানে এক ধরনের ব্যালেন্স করে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। এতে প্রকল্পের খুব বেশি ক্ষতি হয় না।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনা সচিব বলেন, এডিপির বরাদ্দ নির্ধারণের আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়। সেখানে অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন এবং মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর প্রতিনিধিরা থাকেন।

বৈঠকে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার পর সব পক্ষের ঐকমত্যের ভিত্তিতে বরাদ্দ নির্ধারণ করে অর্থ বিভাগ। আবার প্রকল্পভিত্তিক বরাদ্দের গুরুত্ব নির্ধারণে পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেই বরাদ্দ প্রস্তাব তৈরি করা হয়।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, অর্থ বরাদ্দের এই খেলা উভয় পক্ষই খেলে থাকে। মন্ত্রণালয়গুলো যখন চাহিদা দেয় তখন বেশি করেই দেয়।

আবার অর্থ বিভাগ বা পরিকল্পনা কমিশন যখন বরাদ্দ নির্ধারণ করে তখন জানেই যে, তারা বেশি ধরেছে। পরে নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে একটা বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয়। এক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ যতটা-না গুরুত্ব পায়, এর চেয়ে গোষ্ঠী বা ব্যক্তিস্বার্থই বেশি দেখা হয়।

এ ছাড়া গণহারে ছোট ছোট প্রকল্প নিয়ে অল্প বরাদ্দ দিয়ে টিকিয়ে রাখার যে সংস্কৃতি এটি আর্থিক ও পরিকল্পনা শৃঙ্খলা পরিপন্থি। শেষ পর্যন্ত এরকম ক্ষুদ্র বরাদ্দের অধিকাংশ প্রকল্পেই সংশোধন করে মেয়াদ বা ব্যয় বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে।

সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের এডিপি তৈরির জন্য পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগ থেকে গত ১১ মার্চ জারি করা নির্দেশনার ভিত্তিতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর কাছে বরাদ্দ প্রস্তাব চাওয়া হয়।

এ পরিপ্রেক্ষিতে ২ লাখ ৬৬ হাজার ৭৭৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকার চাহিদা আসে। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ১ লাখ ৭৮ হাজার ৮৩৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকা এবং বৈদেশিক সহায়তার ৮৭ হাজার ৯৩৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা চাওয়া হয়।

কিন্তু গত ২৬ এপ্রিল অর্থ বিভাগ থেকে অর্থায়নের উৎসভিত্তিক বিভাজনসহ মোট বরাদ্দ পাওয়া যায় ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ১ লাখ ৩৭ হাজার ২৯৯ কোটি ৯১ লাখ টাকা, যা মোট এডিপির ৬০ দশমিক ৯৩ শতাংশ।বৈদেশিক সহায়তা থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৮৮ হাজার ২৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা, যা মোট এডিপির ৩৯ দশমিক ০৭ শতাংশ।

এই বরাদ্দ ও চাহিদা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সরকারি খাতে চাহিদার তুলানায় ৪১ হাজার ৫৩৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা কম বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে আগামী অর্থবছরের এডিপিতে। এ ছাড়া বৈদেশিক সহায়তা অংশে বরাদ্দ বেড়েছে ৮৭ কোটি ৩১ লাখ টাকা।

পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী যুগান্তরকে বলেন, এক্ষেত্রে যা হয় তা হলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়।

যেসব প্রকল্পের আয়ু বেশি থাকে সেগুলোতে কম বরাদ্দ দিয়ে চালানো হয়। এতে সার্বিকভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নে খুব বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে না।

আগামী অর্থবছরের এডিপি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বেশকিছু প্রকল্পে নামমাত্র বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এত কম বরাদ্দ দেওয়ার অর্থ হচ্ছে প্রকল্পগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা। পরের অর্থবছর বেশি বরাদ্দ দেওয়া হবে।

এরকম কয়েকটি প্রকল্প হচ্ছে : মোংলা বন্দরের ভেসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম প্রবর্তন প্রকল্পে দেওয়া হয়েছে ৬২ লাখ টাকা। যদিও প্রকল্পটির মেয়াদ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে।

তারপরও সামান্য বরাদ্দ দিয়ে আগামী অর্থবছরের এডিপিতে যুক্ত করা হচ্ছে। এ ছাড়া পটিয়া (মনসারটেক)-আনোয়ার কস্তুরীঘাট সড়কের ৯ কিলোমিটারে কালীগঞ্জ সেতু নির্মাণ প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ১ লাখ টাকা।

পশ্চিমাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পসমূহের সম্ভাব্য সমীক্ষা প্রকল্পে দেওয়া হচ্ছে ১ লাখ টাকা। গোবরা থেকে পিরোজপুর পর্যন্ত ব্রডগেজ রেল লাইন নির্মাণ এবং বাগেরহাটে রেল সংযোগ স্থাপনের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই ও বিশদ ডিজাইন প্রকল্পে ১ লাখ টাকা।

ভারতের সঙ্গে রেল সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে চিলাহাটি এবং চিলাহাটি বর্ডারের মধ্যে রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে ৩২ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ রেলওয়ের আখাউড়া-সিলেট সেকশনের মিটারগেজ রেল লাইনকে ডুয়েলগেজ রেল লাইনে রূপান্তর প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ১ লাখ টাকা এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের অবকাঠামো উন্নয়ন, গবেষণাগার স্থাপন ও সক্ষমতা বৃদ্ধি (প্রথম পর্ব) প্রকল্পের আগামী অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ৩০ লাখ টাকা।


শর্টলিংকঃ