থ্যাঙ্ক ইউ ক্যাপ্টেন


ইউএনভি ডেস্ক:

মোহাম্মদ আলির ‘শেষতম’ বাউটে রিংয়ের পাশে ছিলেন অভিনেতা সিলভেস্টার স্ট্যালোন। মন্থর, টলমল আলিকে তার আট বছরের ছোট ল্যারি হোমসের কাছে আত্মসমর্পণ করতে দেখে স্ট্যালোনের গলায় ছিল হাহাকার- ‘মনে হচ্ছে, কোনো জীবিত মানুষের পোস্টমর্টেম করতে দেখছি।’

থ্যাঙ্ক ইউ ক্যাপ্টেন

গতকাল অধিনায়কের ‘শেষ’ ম্যাচের বাউটে আলির মতো অতটা টলমলে না হলেও বিষাদের সুর বেজেছিল নীরবে। সদ্য সিংহাসন ছেড়ে দেওয়া অধিনায়কের বিহ্বল চাহনি আর স্মৃতিপথযাত্রায় সিলেটের চা বাগানঘেরা স্টেডিয়ামটি যেন হয়ে উঠেছিল জলসাঘর ছবির শেষ দৃশ্যের সেই বিশ্বম্বর রায়। কুড়ি বছরের সোনালি অতীত, ড্রেসিংরুমের ঝাড়বাতি, আনুগত্য আর ভালোবাসায় ঘেরা সমর্থককুল- পুরো জলসাঘরই মুহূর্তে সুনসান, আলো নিভে যেতেই যেন অন্ধকারঘেরা চারপাশ! রূঢ়তম বাস্তবতার সঙ্গে মনকে শাসিয়ে সমঝোতা করা- বড় নিষ্ঠুর সেই লড়াই।

অধিনায়ক ‘খেলছেন’ থেকে ‘খেলেছিলেন’- এক দশকের শ্রুতির মুহূর্তের এই রূপান্তর রক্তমাংসের মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হবেই। মাশরাফিও কি বুঝেছিলেন, অধিনায়কত্ব থেকে সরে না দাঁড়ালে তার প্রিয়তম খেলাটারই ক্ষতি হয়ে যাবে।
হয়তো বা বুঝেছিলেন। হয়তো বা বুঝতে বাধ্য হয়েছিলেন। কী হয়েছিল- খেলা ছাড়ার পর কোনো একদিন আত্মজীবনী লিখলে হয়তো এখনকার অনেক প্রশ্নেরই উত্তর পাওয়া যাবে। দিন-ক্ষণ মনে নেই, তবে সময়কালটা ছিল টি২০ থেকে অবসর নেওয়ার আগে আগে।

একদিন বেশ রাতে একটা স্ট্যাটাস দিলেন তিনি- ‘কোথায় কবে কোন তারা ঝরে গেল আকাশ কি মনে রাখে…’। পুরোনো বাংলা গান, নাইনটিজের হিন্দি মেলোডি গান তার খুব প্রিয় জানি। কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘মুছে যাওয়া দিনগুলো’ গানের সেই কলিই কেন ওই রাতে মনে পড়েছিল তার? সেবার টি২০ থেকে তার অবসর নেওয়ার পেছনে কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের বড় চাপ ছিল। কোচ চাইছিলেন তারুণ্যনির্ভর ফিট একটি স্কোয়াড।

মাশরাফিকে বাদ দিয়ে নতুন অধিনায়ক চাওয়ার কথাও তিনি বোর্ড সভাপতির কাছে পরিস্কার জানিয়েও ছিলেন। অধিনায়কত্ব ছেড়ে শুধু ক্রিকেটার হয়ে খেলার প্রস্তাব ছিল তখন মাশরাফির সামনে; কিন্তু তিনি তা মানতে না পেরে কলম্বোতে টস করার সময়ই অবসর ঘোষণা করেন। তার ওই ঘোষণাই তখন চমক ছিল। কিন্তু ওয়ানডেতে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেওয়ার মধ্যে কোনো চমক নেই। বরং তার ‘অবসর’ ঘোষণা না করার মধ্যে কৌতূহল আছে।

মাশরাফি বিন মুর্তজা বাংলাদেশ ক্রিকেটের একটি স্বর্ণ অধ্যায়। নক্ষত্রপুঞ্জের মাঝে তিনিই শশী। তার চন্দ্রাতাপ সূর্যকিরণ হয়ে ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ডের মতো দলকে ঝলসে দিয়েছে। আশরাফুল-পরবর্তী সময়ে তিনিই দলের মধ্যে এই সাহস এনে দিতে পেরেছিলেন যে, প্রতিপক্ষ যতই শক্তিশালী হোক, তাদের খেলোয়াড়রা যতই তারকা হোক- মাঠে নেমে চোখে চোখ রেখে খেলবে বাংলাদেশিরা।

একজন অধিনায়কের জন্য তিনটি কাজ মেধা, বুদ্ধিমত্তা আর কৌশলে করতে হয়। যদি ড্রেসিংরুমে তারকার ভিড় থাকে তাহলে সবাইকে মিলে ‘ড্রেসিংরুমে সুখী পরিবার’ তৈরি করা, যা তিনি পেরেছিলেন। বিদেশি কোচ ও স্টাফদের কৌশল ও চাহিদাগুলো নিজে বুঝে নিয়ে মাঠে সতীর্থদের বুঝিয়ে দেওয়া এবং তাদের কাছ থেকে সেরাটা নিংড়ে নেওয়া, তাতেও মাশরাফি সফল ছিলেন। বোর্ডের সঙ্গে যুক্তি আর তর্কে দলের জন্য সেরা সিদ্ধান্তটা বের করে আনা।

এ ব্যাপারে কখনও কখনও তিনি অসফলও ছিলেন। স্কোয়াড নির্বাচনে কখনও কখনও পছন্দের ক্রিকেটারকে নিতে পারেননি। তবে সর্বোপরি ড্রেসিংরুমের প্রত্যেক সদস্যের কাছ থেকে আস্থা ও ভালোবাসা পেয়েছেন, বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছেন, মিডিয়ার কাছ থেকেও যথেষ্ট সমর্থন আদায় করতে পেরেছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। একটা মানুষের চৌম্বকীয় চৌহদ্দিতে পড়ে সবাই এমন আকর্ষিত হতে পারে, তা দেখিয়ে দিয়েছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। ক্রিকেট ঘিরে এই যে মাদকতা, তা থেকে মুক্তি নিতেই যত কষ্ট হচ্ছিল তার। আর সে কারণেই তিনি ঠিক করেছেন, ‘অধিনায়কত্ব’ ছেড়ে দেবেন, তবে খেলাটি ছাড়বেন না- আপাতত তা চালিয়েই যাবেন।

আসলে বিশ্বকাপের পর গত আট মাসে নিজের মধ্যে লালিত কিছু বিশ্বাসে ধাক্কা খেয়েছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। নিজের সঙ্গে অনেক লড়াই করে তাই একরকম সিদ্ধান্তও নিয়েছেন নতুন করে শুরু করার, হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন ‘নতুন শুরু’। যে মাশরাফি বিন মুর্তজা ঠিক করেছেন আবদুর রাজ্জাক, তুষার ইমরান, শাহরিয়ার নাফীসদের মতো ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে যাবেন। পারফর্ম করেই দেখিয়ে দেবেন, তিনি ফুরিয়ে যাননি।

তার নিজস্ব এ ইচ্ছাকে সম্মান জানাতেই হয়। কিন্তু তার পরও যে নিষ্ঠুর প্রশ্নটি থেকে যায়- বয়স কি তার এই নতুন শুরুকে সাপোর্ট করবে? দুই পায়ে ১১টি সেলাই নিয়ে, ম্যাচের আগে পুরো পায়ে টেপ লাগিয়ে আর কত পথ দৌড়াবেন তিনি? উত্তরের জন্য মাশরাফিও বুঝি বা সময়ের দিকেই তাকিয়ে। এ লড়াইটি মাশরাফির শুধুই একার।

কেননা বিশ্বকাপের পর থেকে এ পর্যন্ত কিছু বাস্তবতা তাকে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে তা। বড় ধাক্কাটি খেয়েছিলেন মাশরাফি ক্রিকেটারদের ধর্মঘটের সময়। নিজেদের দাবি আদায়ে দেশের সব ক্রিকেটার যখন এক মঞ্চে, তখন মাশরাফিকে ডাকেইনি কেউ। তাহলে কি ওরা আমাকে ওদের কেউ মনে করে না?- এই প্রশ্ন অনেক দিন ধরে মাশরাফিকে অস্থির রেখেছে। অনেক রাত ঘুমাতে দেয়নি তাকে।

বিশ্বাসভঙ্গের সে আঘাতটি এখনও ভোলেননি তিনি। এরপর বিসিবির কেন্দ্রীয় চুক্তিতে তার থাকা না থাকা নিয়ে বোর্ডের পরিচালকদের মধ্যে কানাঘুষা তৈরি হয়। মাশরাফি বুঝে নেন, তাকে আর কেন্দ্রীয় চুক্তিতে রাখতে চাচ্ছে না বোর্ড। সেটাও একটা ধাক্কা ছিল তার। বিশ্বকাপের সময়ই মাশরাফির ‘অতিপ্রিয়’ সাংবাদিক ভাইয়েরা আজই কি শেষ ম্যাচ, আজই কি অবসরে যাচ্ছেন- নিয়ে একের পর এক খবর প্রচার করে, তাতেও যেন বিশ্বাসভঙ্গের ধাক্কা খান মাশরাফি। এরপর মিডিয়ার সঙ্গে বেশ কয়েক মাস দূরত্ব রেখে চলেন।

তবে সর্বশেষ ধাক্কাটি ছিল তার কাছে সিলেটে এসে সংবাদ সম্মেলনে ‘আমি কি চোর…’ বলাটি। সাংবাদিকের ওপর রেগে গিয়ে তার ওই কথাটি রাজনৈতিক অঙ্গনেও নাড়া দেয়। নেতিবাচক প্রচার চলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, যা কিনা নীতিনির্ধারকের দিক থেকে মাশরাফির পক্ষে যায়নি। আসলে তারকাদের জনসমক্ষে আবেগের বহিঃপ্রকাশ বারণ, চর্চিত অনুশীলনে ঢেকে রাখতে হয় অন্তর্লীন উথালপাথাল, ভেতরের ভাঙচুর। তবু আদতে মানুষ তো! আবেগের শেষ সীমান্তে পৌঁছে গেলে সব প্রতিরোধই বুঝি বা ভেসে যায়।

তবে অধিনায়ক বিদায় নিলেও বাংলাদেশ ক্রিকেটের ঝড়ের দিনগুলোতে (টাকার হাতছানিতে আইসিএলে অনেকের চলে যাওয়া, আশরাফুলের বিরুদ্ধে ফিক্সিংয়ের অভিযোগ ওঠা, আরও অনেক কিছু যা অন্য কখনও লেখা যাবে) আপনিই ছিলেন ‘পরানসখা’। থ্যাঙ্ক ইউ ক্যাপ্টেন…। থ্যাঙ্কস ফর গিভ আস এভরিথিং…। আপনি লিখেছিলেন না- ‘কোথায় কবে কোন তারা ঝরে গেল আকাশ কি মনে রাখে…’। আপনাকে বলছি, রাতের সব তারারাই থাকে দিনের আলোর গভীরে।


শর্টলিংকঃ