নাটোরে নারদ নদের বেড়িবাঁধের মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়


নিজস্ব প্রতিবেদক, নাটোর:

নাটোরের নারদ নদের বেড়িবাঁধ বা তীরের মাটি কেটে বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এক প্রভাবশালী। বেড়িবাঁধের ওপর বড় বড় গাছ এবং বাঁশের বাগান থাকলেও তা কেটে ফেলা হয়েছে। গত একমাস ধরে এসব মাটি বিক্রি করা হয়েছে বিভিন্ন ইটভাটার মালিকদের কাছে।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, এমনকি ভূমি অফিসের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানলেও কেউ বাধা দেয়নি। বেড়িবাধ কেটে ফেলার কারণে আগামী দিনে বড় বন্যা হলে বাড়ি-ঘরের পাশাপাশি ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

তবে বেড়িবাঁধের মাটির কাটার সঙ্গে জড়িত আবদুর রাজ্জাক স্থানীয়দের ওপর দোষারোপ করলেও বিষয়টি জানার পর আইনি প্রদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নাটোর সদর উপজেলার মাটিকোপা এবং সিংড়া উপজেলার গুনাইখাড়া মৌজার বগুড়াপাড়া এলাকার নারদ নদের অন্তত দুই কিলোমিটার জুড়ে বেড়িবাঁধের মাটি কেটে নিয়েছে প্রভাবশালীরা।

১০ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার বেড়িবাধের মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিভিন্ন ইটভাটায়। তাছাড়া বেড়ি বাধের ওপর বড় বড় গাছ এবং বাঁশ ঝাড় থাকলেও সেগুলো কেটে ফেলা হয়েছে হরহামেশেই। সবার চোখের সামনে এসব ঘটলেও বাধা দেয়নি কেউ।

তাছাড়া মাটি কেটে নেওয়ার পর পরই অনেকে সেখানে ভুট্টা রোপণ করেছেন। বর্তমানে মাটি কাটার এস্কেভেটর মেশিন পড়ে রয়েছে সেখানে। তবে আগামী দিনে বড় বন্যা হলে বাড়ি-ঘরের পাশাপাশি পাশের মাঠের ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

মাটিকোপা গ্রামের হাসিব হোসেন বলেন, গত একমাস ধরে স্থানীয় প্রভাবশালী আবদুর রাজ্জাক নামে এক ব্যক্তি মাটিগুলো কেটে নিয়ে যাচ্ছিল। তাকে কেউ বাধাও দেয়নি। অনেকে নিষেধ করলেও সে তোয়াক্কা করেনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যক্তি বলেন, আবদুর রাজ্জাক সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের পিএস আকরামুল ইসলামের ঘনিষ্টজন হিসেবে পরিচিত। সে তাদের দোহাই দিয়ে একের পর এক অপরাধ করে যাচ্ছে।

স্থানীয়রা জানান, আশির দশকে নারদ খনন করার সময় মাটিগুলো রাখার জন্য ব্যক্তি মালিকানা জমি অধিকগ্রহণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পরে নদী খনন করে সে মাটি তীরে রাখা হয়।

এরপর দখল করে দীর্ঘ দিন ধরে সেখানে বসবাস করে আসছে স্থানীয়রা। এরই মধ্যে পাকা এবং টিনশেড ঘর তৈরি করে স্থায়ী ভাবে বসবাস করছে তারা।

আমেন বেগম নামের এক নারী বলেন, নদীর বেড়িবাধ অনেক উচুঁ হওয়ার কারণে তারা শুকনো মৌসুমে ঠিকমত পানি পান না। যার কারণে নিজেদের সুবিধার জন্য রাজ্জাকের কাছে মাটি বিক্রি করে দিয়েছেন। মাত্র ৮০টাকা গাড়ি মাটিগুলো বিক্রি করা হয়েছে।

সরকারি জায়গার মাটি বিক্রি করলেন কিভাবে এমন প্রশ্নে আমেনা বেগম বলেন, সবাই মাটি বিক্রি করেছে, তাই আমরাও বিক্রি করেছি।

আরেক নারী হাসিনা বেগম বলেন, না বুঝেই আমরা মাটি বিক্রি করে দিয়েছি। আবদুর রাজ্জাক নামের এক ব্যক্তি এসব মাটি কিনে নিয়েছে। গাছগুলোও সে নিয়ে গেছে।

সদর উপজেলার হালসা ইউনিয়নের মাটিকোপা গ্রামের কাউছার আলী জানান, গত ১৫ মার্চ শুক্রবার নারদ নদের তীর বা বেড়িবাধের মাটি কেটে বহনের সময় ট্রাক্টরের চাপায় মাটিকোপা গ্রামের জহির উদ্দিনের ছেলে এমদাদুল নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়।

এরপর ক্ষুদ্ধ এলাকাবাসীরা সিংড়া পৌরসভার মেয়র জান্নাতুল ফেরদৈসের মাটি বহনের তিনটি ট্রাক্টর পুড়িয়ে দেয়। এরপরই বেড়িবাধের মাটিকাটার বিষয়টি প্রকাশ পায় উল্লেখ করেন তিনি।

পরে সদর থানা পুলিশ এসে মাটিকাটা বন্ধ করে দিয়ে যায়। তবে মাটি কাটার সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নেওয়ার জোর দাবি জানান তিনি।

হালসা ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য আবদুল আজিজ মন্ডল বলেন, বেড়িবাধ বা নদীর তীরের মাটি কাটার কারণে হুমকির মুখে রয়েছে অনেক গাছ এবং বাঁশ বাগান। একটু বৃষ্টি হলেই যে কোন সময় ভেঙে পড়তে পারে।

এতে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া সরকারি জায়গায় মাটি কাটার পর অনেকে সেখানে আবাদও শুরু করেছেন। স্থানীয় ব্যক্তিরা নামমাত্র মূল্যে মাটি বিক্রি করলেও এই সুযোগে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে স্থানীয় একটি চক্র বলেন তিনি।

তবে অভিযুক্ত আবদুর রাজ্জাক বলেন, বেড়িবাঁধের ওপর বাসবাসকারীরা তাদের নিজেদের সুবিধার জন্য মাটি বিক্রি করেছে। আর সে মাটিগুলো আমি কিনে নিয়েছে। স্থানীয় ব্যক্তিরা জমিগুলো নিজেদের দাবি করেই আমার কাছে তারা মাটি বিক্রি করেছে।

সিংড়া উপজেলার নির্বাহী অফিসার সুশান্ত কুমার মাহাতো বলেন, খবর পাওয়ার পর ঘটনাস্থলে এসিল্যান্ডকে পাঠানো হয়েছিল। জায়গাটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের হওয়ার কারণে তারাই দোষিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে।

সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা জেসমিন আক্তার বানু বলেন, বেড়িবাঁধের মাটি বেশির ভাগ সিংড়া উপজেলার মধ্যে। তারপরও দুই উপজেলার এসিল্যান্ডসহ অন্যদের পাঠানো হয়েছিল। তারা দেখে এসে আমাকে রিপোর্ট দিয়েছে। যেহেতু জায়গা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সে কারণে আইনি প্রদক্ষেপ তারাই নিবে।

নাটোর সদর উপজেলা (সহকারী কমিশনার ভূমি) আবু হাসান জানান, ঘটনা জানার পর তিনি মাটি কোপা গ্রামে যান। এসময় নন্দকুজা নদী থেকে ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের আবদুর রাজ্জাক নামে এক ব্যক্তির মাটির ভেকু মেশিন দিয়ে মাটি কাটার সত্যতা পাওয়া যায়।

পরে তিনি অবৈধভাবে নদী থেকে মাটি কাটা এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করায় একটি ভেকু মেশিন ও ক্ষতিগ্রস্ত তিনটি ট্রলি জব্দ করে স্থানীয় ইউপি সদস্য আ. আজিজ মন্ডলের হেফাজতে দেন। এসময় সিংড়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) বিপুল কুমার অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।

নাটোর সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কাজী জালাল উদ্দিন বলেন, এই বেড়িবাঁধের মাটি বহনের সময় স্থানীয় একব্যক্তিকে চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। যার কারণে স্থানীয়রা তিনটি ট্রাক্টর পুড়িয়ে দিয়েছে।

পরে খোঁজ নিয়ে গিয়ে দেখা যায়, ঝুঁকিপূণ ভাবে বেড়িবাঁধের মাটি কাটা হয়েছে। পরে মাটিকাটা বন্ধসহ ভেকু মেশিনের ব্যাটারি জব্দ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। থানায় কেউ অভিযোগ দিলে দোষিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান ওসি।

নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান বলেন, বিষয়টি জানার পর সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। এরপর নদীর তীর বা বেড়িবাঁধের মাটি কাটার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।


শর্টলিংকঃ