নির্বাচনী প্রচারণায় বিশ্বের প্রথম ‘এআই কর্মী’


যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচনে জয়ী হতে প্রথমবারের মতো নির্বাচনী প্রচারণায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সহায়তা নিচ্ছেন এক মার্কিন রাজনীতিবিদ। নতুন এআইভিত্তিক রাজনৈতিক প্রচারণা ব্যবস্থাটির নাম ‘অ্যাশলি’।

মার্কিন কংগ্রেসে সদস্য হওয়ার প্রত্যাশা করছেন দেশটির ডেমোক্র্যাট দলের রাজনীতিবিদ শামেইন ড্যানিয়েলস। আর তার চোখ ট্রাম্প সমর্থিত রিপাবলিকান দলের প্রতিনিধি স্কট পেরির আসনে, যিনি ২০২০ সালের ফলাফল চ্যালেঞ্জ জানানোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।

গত বছর পেরির কাছে ১০ পয়েন্টেরও কম ব্যবধানে হেরেছিলেন ড্যানিয়েলস। তবে তিনি আশা করছেন, তার নির্বাচনী প্রচারণায় এবার নতুন অস্ত্র হিসেবে সাহায্য করবে অ্যাশলি।

রয়টার্স বলছে, অ্যাশলি গতানুগতিক ‘রোবকলার’ প্রযুক্তির মতো নয়। আর এর কোনো জবাবই আগে থেকে রেকর্ড করা থাকে না। আর এর নির্মাতারা মূলত ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রচারণা ও প্রার্থীদের জন্য কাজ করে থাকেন। তাদের মতে, এটিই প্রথম রাজনৈতিক ফোন ব্যাংকার, যেখানে ওপেনএআইয়ের চ্যাটজিপিটি’র মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।

এ ছাড়া, একই সময়ে অসংখ্য নাম্বারে ‘কাস্টমাইজড’ উপায়ে কথোপকথন চালাতে সক্ষম এটি।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি যে রাজনৈতিক প্রচারণায় নতুন যুগ শুরু করছে, তার প্রথমদিকের উদাহরণ হল অ্যাশলি, যেখানে প্রার্থীরা এআই প্রযুক্তির সহায়তায় এমন ভোটারদের সঙ্গেও যোগাযোগ করছেন, যাদের ট্র্যাক করা কিছুটা জটিল।

ভোটারদের একটি অংশের দাবি, অ্যাশলি এমন এক চমকপ্রদ নতুন টুল, যার মাধ্যমে বড় পরিসরে উচ্চমানের কথোপকথন চালানো সম্ভব। তবে আরেকটি অংশ বলছে, এর মাধ্যমে মার্কিন রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ভুল তথ্যের প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে, যা এরইমধ্যে ‘ডিপফেইক’-এর মতো প্রযুক্তির সঙ্গে লড়াই করছে। ডিপফেইক এমন এক ধরনের প্রযুক্তি, যেখানে এআই অ্যালগরিদম ব্যবহার করে সত্যিকারের মানুষের অবিকল অথচ কৃত্রিম ছবি ও ভিডিও তৈরি করা হয়।

এ সপ্তাহান্তে ড্যানিয়েলসের পক্ষ থেকে পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের হাজার হাজার ভোটারকে কল দিয়েছে অ্যাশলি। একজন অভিজ্ঞ নির্বাচনী প্রচারকের মতোই অ্যাশলি ভোটারের প্রোফাইল বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন বিষয়ে তার সঙ্গে কথোপকথন চালায়। এ ছাড়া, মানুষের মতো চাকরিতে ফাঁকিও দেয় না এটি।

এ ছাড়া, ড্যানিয়েলসের সকল প্রতিশ্রুতিও নিখুঁতভাবে স্মরণ করে এটি। এমনকি কেউ কল কেটে দিলেও হতাশ হয়না চ্যাটবটটি।

“এর কার্যকারিতা দ্রুতই বাড়তে দেখা যাবে।” –বলেন অ্যাশলি’র লন্ডনভিত্তিক নির্মাতা কোম্পানি ‘সিভক্স’-এর সিইও ইলায়া মউজিকানস্কি।

“বছরের শেষ নাগাদ আমরা দৈনিক হাজার হাজার কল দেওয়ার লক্ষ্য স্থির করেছি। এ ছাড়া, খুব শীঘ্রই এ সংখ্যা ছয় অঙ্কের ঘরে গিয়ে পৌঁছাবে। এটি ২০২৪ সালের নির্বাচনের জন্য তৈরি। খুব বড় পরিসরে আসবে এটি… আর এটাই ভবিষ্যৎ।”

ড্যানিয়েলসের মতে, আন্ডারডগ প্রার্থী হিসেবে তার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করেছে চ্যাটটটি। এ ছাড়া, অ্যাশলি ২০টি’র বেশি ভাষায় দক্ষ হওয়ায় ভোটারদের চাহিদা বোঝার নতুন উপায় হিসেবেও কাজ করবে এটি।

তবে, মে মাসে মার্কিন কংগ্রেসের সামনে সাক্ষ্য দেওয়া ওপেনএআই সিইও স্যাম অল্টম্যান’সহ অনেকেই এ প্রযুক্তির বিকাশ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া, এআই ব্যবস্থাটি ভোটারের সঙ্গে একক কথোপকথন চালানোর সময় ভুল তথ্য দেবে কি না, তা নিয়েও ‘সন্দেহ’ রয়েছে অল্টম্যানের।

ইন্টারনেটের ডেটার মাধ্যমে প্রশিক্ষিত এআই প্রযুক্তি বর্তমানে বাস্তবিক কথোপকথন চালানোর ক্ষেত্রে এতটাই ভালো হয়ে উঠেছে যে, সাম্প্রতিক মাসগুলোয় বিভিন্ন এআই চালিত চ্যাটবটের প্রেমে পড়তে দেখা গেছে ব্যবহারকারীদের। এমনকি এদের কাউকে বিয়ে করার ঘোষণাও দিয়েছেন কেউ কেউ।

মউজিকানস্কি বলেন, তিনি এর ত্রুটিগুলো সম্পর্কে ওয়ালিবহাল। তাই এর জন্য কোনো তহবিল সংগ্রহের ইচ্ছাও নেই তার। কারণ, এমনটি করলে নীতির চেয়ে আর্থিক লাভকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হবে।

ওপেনএআইয়ের মতোই অস্বাভাবিক এক নিয়ন্ত্রণ কাঠামো গঠন করছেন তিনি, যেখানে তাকে কোম্পানির কোনো তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশে বাধ্য করার ক্ষমতা দেওয়া হবে এক কমিটিকে।

সিভক্স সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা অ্যাশলি’কে রোবটের মতো কণ্ঠস্বর দেবে। আর এটি নিজেই প্রকাশ করবে যে, এটি একটি এআই ব্যবস্থা। তবে, এমনটি করার কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে রয়টার্স।

চ্যাটবটটি বানাতে কোন এআই মডেল ব্যবহৃত হয়েছে, সে সম্পর্কে তথ্য দিতে রাজি হননি মউজিকানস্কি ও সিভক্সের আরেক সহ-প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডাম রেইস।

তারা কেবল বলছেন, এতে ২০টি ভিন্ন এআই মডেল ব্যবহার করা হয়েছে, যার কয়েকটি ব্যক্তিমালিকানাধীন ও কয়েকটি ওপেন-সোর্স।

সম্প্রতি প্রকাশ পাওয়া বিভিন্ন জেনারেটিভ এআই প্রযুক্তির সহায়তায় গোটা পণ্যটি প্রায় নিজে নিজেই তৈরি করেছেন রেইস। তার মতে, কয়েক বছর আগেও এমনটি করতে অন্তত ৫০ জন প্রকৌশলীর দল প্রয়োজন পড়ত।

আইনি জটিলতা

নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে এআই ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু আইনি নির্দেশিকা রয়েছে।

“আমি জানি না, ফেডারেল আইনের অধীনে এটি অবৈধ কি না।” –বলেন মার্কিন অলাভজনক সংগঠন পাবলিক সিটিজেন-এর প্রেসিডেন্ট রবার্ট ওয়েইসম্যান।

নির্বাচনী প্রচারণায় ডিপফেইক প্রযুক্তি ব্যবহারে আইনী নিষেধাজ্ঞা দেওয়া অঙ্গরাজ্যগুলোর একটি হল মিশিগান। তবে, ড্যানিয়েলসের নির্বাচনী এলাকা পেনসিলভানিয়ায় এমন কোনো আইন নেই।

সিভক্সের কার্যক্রম ঠেকানোর মতো সরাসরি কোনো নীতিমালা নেই। মার্কিন সংস্থা এফটিসি ‘ডু নট কল রেজিস্ট্রি’ তালিকায় থাকা টেলিমার্কেটারদের রোবকল দেওয়া নিষিদ্ধ করলেও, ওই তালিকায় রাজনৈতিক কলের বিষয়টি উল্লেখ না থাকায় সিভক্সের কার্যক্রম ‘রোবকলিং’-এর আওতাধীন নয়।

অন্যদিকে, মার্কিন নিয়ন্ত্রক সংস্থা এফসিসি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে প্রচারণা সংশ্লিষ্ট অটোডায়াল বা আগেই রেকর্ড করা ভয়েস কলের ওপর। এর মধ্যে রয়েছে ভোটারের অনুমতি ছাড়া ফোনে সরাসরি অটোডায়াল করার বিষয়টিও।

এআই প্রযুক্তি কীভাবে অবৈধ ও অযাচিত রোবকলের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে, তা নিয়েও তদন্ত শুরু করছে এফসিসি।

এ ছাড়া, নির্বাচনী প্রচারণায় এআই প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যায় কি না, সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখছে সংস্থাটি।

তবে, মউজিকানস্কি’র তৈরি প্রযুক্তি ব্যবহারে এ নিয়মগুলো প্রযোজ্য নয়।

এআই নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, এ প্রযুক্তিতে ভুল তথ্য ছড়ানোর ঝুঁকি আছে। তিনি আরও যোগ করেন, অন্যান্য কোম্পানি হয়ত এমন এআই কলার তৈরি করতে পারে, যেগুলো সত্যিকারের মানুষের কণ্ঠের মতোই শোনাবে। আর তা যে এআইয়ের মাধ্যমে তৈরি, সেটিও প্রকাশ করা হবে না।

“আমরা এমন ভবিষ্যৎ সংস্করণের কতোটা কাছাকাছি আছি, যার অস্তিত্ব এর আগে কেবল সাই-ফাই সিনেমা ও বইয়ের মধ্যেই পাওয়া গেছে, সে ধারণার উদ্দীপক হিসেবে কাজ করতে পারে এটি।” –বলেন তিনি।

“আর নিয়ন্ত্রক ও আইন প্রণেতারদের জন্য এ কারণটিই যথেষ্ট। আর কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরং গোটা বিশ্বেই এ বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া উচিৎ।”

অ্যাশলি যে মানুষ নয়, তা তাৎক্ষণিক বুঝে ফেলার পরও এর কণ্ঠস্বর শুনে মজা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন ৬৩ বছর বয়সী মার্কিন নাগরিক ডেভিড ফিশ।

“এটি আমার মনযোগ আকর্ষণ করেছে।” –বলেন তিনি।

“আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে যে, এটি নিজেকে এআই হিসেবেই পরিচয় দিয়েছে। আর আমাকে বোকা বানানোরও চেষ্টা করেনি এটি।”


শর্টলিংকঃ