পডকাস্টের যন্তরমন্তর


পশ্চিমা দেশগুলোতে অডিও পডকাস্ট বেশি জনপ্রিয় হলেও দেশে আলোচনা অনুষ্ঠানের মতো ভিডিও পডকাস্টও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পছন্দের বিষয়বস্তুর ওপর বিশেষজ্ঞদের মতামত ও আলোচনা শুনতে পছন্দ করেন এমন অডিয়েন্সদের পাশাপাশি রেডিও শোর মতো করে লাইভ আলোচনা এবং বক্তাদের সঙ্গে কমেন্টে কথাবার্তা চালাতে পছন্দ করেন এমন অডিয়েন্সের সংখ্যাও কম নয়। তবে পডকাস্টের জনপ্রিয়তার মূলে আছে ইচ্ছামতো যেকোনো সময় সেটা শুনতে পারার স্বাধীনতা। দেখা গেছে, কাজের ফাঁকে বা গাড়ি চালানোর সময়ই সবচেয়ে বেশি পডকাস্ট শোনেন অডিয়েন্সরা।

পডকাস্ট তৈরিতে তেমন খরচের বালাই নেই দেখে অন্যান্য ফরম্যাটের চেয়ে অনেক বেশি নির্মাতা পডকাস্ট নিয়ে কাজ করছেন। তাই একেবারে অপ্রচলিত, অদ্ভুত সব বিষয়বস্তুর ওপরও পডকাস্টের অভাব নেই। সেসব বিষয়ের ভক্তরাও পডকাস্ট শোনার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী।
পডকাস্টের জন্য সেরা মাধ্যম

পডকাস্ট হোস্ট করার জন্য বেশ কিছু সেবা রয়েছে।

 

তবে সমস্যা একটাই, কোনোটাই বিনা মূল্যে ব্যবহারের উপায় নেই। যে কারণে দেশি পডকাস্টাররা ফেসবুক লাইভ ও ইউটিউবে ভিডিও পডকাস্ট আপলোড করেই কাজ শুরু করছেন। এসব মাধ্যমে কাজ করার সমস্যা একটাই, স্পটিফাই, গুগল পডকাস্ট, অ্যাপল পডকাস্ট বা ডিজারের মতো যেসব সেবার মাধ্যমে অডিয়েন্সরা নতুন সব পডকাস্ট খুঁজে বের করেন বা পছন্দের পডকাস্টের তালিকা তৈরি করেন, সেসব সেবায় ফেসবুক বা ইউটিউবের লিংক কাজ করে না। সে ক্ষেত্রে বাজস্প্রাউট, ক্যাপ্টিভেট, ক্যাস্টোস বা আরএসএস ডটকমের মতো সেবার মাধ্যমে পডকাস্ট হোস্ট করা সবচেয়ে কাজের।

 

সেবাগুলোর দামও তেমন বেশি নয়, মাসে ১০ থেকে ২৫ ডলারের মধ্যে। অবশ্য যাঁদের নিজের ব্লগ বা ওয়েবসাইট আছে, তাঁরা চাইলে সেই হোস্টিংয়ের মধ্যেও পডকাস্ট আপলোড করতে পারবেন। ওয়ার্ডপ্রেসে তৈরি সাইটে পডকাস্ট হোস্ট করা খুবই সহজ। তবে একেবারে শুরুতে ইউটিউব বা ফেসবুকে ভিডিও পডকাস্ট করাই সবচেয়ে সহজ উপায়, কোনো বাড়তি খরচ না করেই শ্রোতা-দর্শক যাচাই করার জন্য।

পডকাস্টের ফরম্যাট তৈরি
যদিও পডকাস্টের জন্য পূর্ণাঙ্গ স্ক্রিপ্ট তৈরির প্রয়োজন হয় না, তার পরও কিছু জিনিস শুরুতেই ঠিক করে নিতে হবে।

 

নিজের পছন্দের কিছু বিষয়বস্তু থেকে পডকাস্টের টপিক বাছাই করে নিতে হবে শুরুতে। যে বিষয়ে নিজের জ্ঞানের অভাব নেই, চাইলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেটি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করা যাবে, এমন কিছু নিয়েই করতে হবে পডকাস্ট।
এরপর ঠিক করতে হবে, পডকাস্টের উপস্থাপক থাকবেন কয়জন, তাঁরা ক্যামেরার সামনে কাজ করতে আগ্রহী কি না। অডিও পডকাস্টের চেয়ে আজকাল ভিডিও পডকাস্ট বেশি জনপ্রিয়, সে বিষয় মাথায় রাখা খুবই জরুরি। ফরম্যাট অনুযায়ী পডকাস্ট রেকর্ড ও সম্পাদনা করার জন্য প্রয়োজনীয় হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার রেডি করতে হবে।

প্রথম কয়েকটি রেকর্ডিং ভালো না-ও হতে পারে, তার পরও সেগুলো সম্পাদনা ও আপলোড করা জরুরি শুধু অনুশীলন হিসেবে। প্ল্যাটফরম যদি হয় ফেসবুক বা ইউটিউব, তাহলে সেখানে ভিডিও আপলোড করার সময় খেয়াল রাখতে হবে, কোনো কারণে যাতে কপিরাইট স্ট্রাইক করার মতো কিছু না থাকে। ভিডিও হোক বা অডিও, চমৎকার লোগো ও থাম্বনেইল তৈরি করা খুবই জরুরি, যাতে নতুন দর্শক ও অডিয়েন্স আকৃষ্ট হন। যাঁরা পডকাস্টের হোস্টিংয়ে আপলোড করবেন, তাঁরা চাইলে এরপর আরএসএস, গুগল, স্পটিফাই বা অ্যাপলের পডকাস্ট ডিরেক্টরিতে লিংক দিতে পারেন, যাতে তাঁদের কনটেন্ট সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়।

হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার

অডিও পডকাস্টের জন্য মাইক্রোফোন ও রেকর্ড করার ডিভাইস থাকলেই যথেষ্ট। সেটা হতে পারে ল্যাপটপ, ডেস্কটপ থেকে শুরু করে ট্যাবলেট বা স্মার্টফোন পর্যন্ত। ভালো মানের মাইক্রোফোন খুবই জরুরি, আজকাল বেশির ভাগ ভিডিও পডকাস্টারই ল্যাপেল মাইক ব্যবহার করে থাকেন। বয়া, ফিফাইন, মায়োনোর মতো ব্র্যান্ডগুলো দেড় হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে দু-তিনটি মাইক্রোফোনের কম্বো বিক্রি করছে, সেগুলো চাইলে ফোন বা ল্যাপটপ দুটিতেই ব্যবহার করা যাবে। যাঁরা বেশ সিরিয়াসলি পডকাস্ট করতে চাইছেন তাঁরা চাইলে ‘রোড’ ব্র্যান্ডের মাইক্রোফোনও কিনতে পারেন। যদি স্থায়ী স্টুডিও করার ইচ্ছা থাকে সে ক্ষেত্রে আরো উন্নত সাউন্ডের জন্য কার্টিওয়েড মাইক্রোফোনকে বুম আর্ম ও ফিল্টারের সঙ্গে সেট করে রাখা যেতে পারে; যদিও সেটা সহজে স্থানান্তর করা যাবে না।
ভিডিও পডকাস্টের মুখে বড় চ্যালেঞ্জ, উপস্থাপক ও অতিথি—দুজনের ভিডিও একসঙ্গে ধারণ করা। কাজটি স্মার্টফোনেই করা সম্ভব, সামনের ও পেছনের দুটি ক্যামেরায় একসঙ্গে ভিডিও ধারণ করার জন্য ডাবল টেকের মতো অ্যাপ ব্যবহার করা যেতে পারে। বেশ কিছু স্মার্টফোনে ফিচারটি বিল্ট-ইনও থাকে। ফোনে মাইক্রোফোন সংযুক্ত করে, ভিডিও ধারণের অ্যাপ চালু করে ফোনটিকে ট্রাইপডে সেট করে উপস্থাপক ও অতিথি মুখোমুখি বসে পডকাস্ট ধারণ করা যাবে। এরপর ফুটেজটি ‘ফিলমোরা’ বা ‘ক্যাপকাট’-এর মতো অ্যাপের সাহায্যে সম্পাদনা করে সহজেই পডকাস্টের কনটেন্ট ফোনেই তৈরি করা সম্ভব। তবে পিসিতে ‘প্রিমিয়ার প্রো’ বা ‘দ্য ভিঞ্চি রিসলভ’ সফটওয়্যারে ভিডিও সম্পাদনা করার ফিচার পাওয়া যাবে আরো বেশি। অডিও সম্পাদনা করার জন্য স্মার্টফোনে মিউজিক অডিও এডিটর বা পিসিতে অডাসিটি ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রফেশনাল পডকাস্ট রেকর্ড ও সম্পাদনা করার জন্য বিশেষায়িত স্যুটও রয়েছে, তবে সেটা শুরুতেই প্রয়োজন নেই।

পডকাস্টের মান বাড়াতে চাইলে মনে রাখতে হবে, বাইরের শব্দ ও অতিরিক্ত প্রতিধ্বনি যাতে অডিওতে না আসে। সে জন্য বেছে নিতে হবে যত দূর সম্ভব শব্দহীন রুম, জানালায় লাগাতে হবে পর্দা এবং দেয়ালে সম্ভব হলে শব্দ কমানোর জন্য ফোম। ভিডিও পডকাস্ট হলে উপস্থাপক ও অতিথি—দুজনের জন্যই রিং লাইট ব্যবহার করা উত্তম, সঙ্গে মানসম্মত টেবিল ও পেছনের ব্যাকড্রপ। বর্তমানে প্রতিটি জিনিসই সহজলভ্য এবং দামও নাগালের মধ্যেই।
পডকাস্টের প্রসার

শুরুতেই তেমন ভিউ বা স্ট্রিম না হওয়াই হবে স্বাভাবিক। বিশেষ করে ট্রেন্ডিং টপিকের বাইরের বিষয়বস্তু নিয়ে কাজ করলে অডিয়েন্স জোগাড় করাটা হবে বেশ কঠিন। নিয়মিত মানসম্মত পডকাস্টের পর্ব আপলোড করা এবং সেগুলোর লিংক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিভিন্ন ব্লগে শেয়ার করা এবং এর মধ্যেই জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বদের পেজ বা তাঁদের ভ্লগ বা কনটেন্টের সঙ্গে কোলাবরেশন করেই নিজের অডিয়েন্স বাড়াতে হবে। তবে গিভাওয়ে বা স্পন্সরশিপের কন্টেন্ট শুরুতেই না করা ভালো, কেননা তাহলে অতি চটকের টানে কিছু অডিয়েন্স এলেও তাদের ধরে রাখা কঠিন। এর চেয়ে বরং অডিয়েন্সের মন্তব্যের উত্তর দেয়া, তাদের মাঝে পোল করে টপিক বাছাই করার মত কাজগুলো করে ফ্যানবেস তৈরি করতে হবে। যদি বাংলার পাশপাশি ইংরেজিতেও কন্টেন্ট করা যায় তাইলে বৈশ্বিক শ্রোতা-দর্শকের কাছেও পৌছানো সম্ভব। মনে রাখতে হবে, একটি পর্ব তৈরি করেই হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না।
পডকাস্ট থেকে আয়

ভিডিও কনটেন্টের মতই, পুরোটাই নির্ভর করছে অডিয়েন্সের ওপর। ইউটিউব বা ফেসবুকে ভিডিও মনিটাইজ করার মত অন্যান্য পডকাস্ট প্ল্যাটফর্মেও মনিটাইজেশন করা সম্ভব, তবে অডিয়েন্সের সংখ্যা বাড়লে স্পন্সরশিপের জন্য চেষ্টা করা যেতে পারে। সেটা অবশ্যই অডিয়েন্স ও পডকাস্টের বিষয়বস্তুর সঙ্গে সামঞ্জস্যতাপূর্ণ হতে হবে। তবে দিনশেষে শুধুমাত্র আয়ের চিন্তা করেই পডকাস্টের দুনিয়ায় আসা ঠিক হবে না, অন্যান্য সৃজনশীল কাজের মতই এখানে আগে নিজের মেধা তুলে ধরতে হবে, রোজগার আসবে সেখান থেকেই।


শর্টলিংকঃ