বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য লজ্জা: ফকির আলমগীর


বাংলাদেশের প্রখ্যাত গণসংগীত শিল্পী ফকির আলমগীর। ১৯৬৬ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। রাজপথে বিভিন্ন আন্দোলনে তাঁকে বহুবার দেখা গেছে। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে গণসংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন তিনি। একাত্তরে শব্দ সৈনিক হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেন। শুধু তাই নয়, অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে লড়াই করেছেন। মহান বিজয় দিবসে দেশবরেণ্য এই শিল্পীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাইজিংবিডির জ্যেষ্ঠ বিনোদন প্রতিবেদক রাহাত সাইফুল।

রাইজিংবিডি : ভাস্কর্য নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কথা শোনা যাচ্ছে। বিজয়ের মাসে জাতির পিতার ভাস্কর্য ভেঙেছে দুর্বৃত্তরা। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

ফকির আলমগীর : আমরা একাত্তরে যখন যুদ্ধ করেছি তখনকার সাংস্কৃতিক পরিবেশ এখন নেই। স্বাধীনতার পর আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি বিভিন্ন সময় বিকারগ্রস্ত হয়েছি। আমরা মৌলবাদী শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়েছি। আমি মনে করি, ভাস্কর্য এবং মূর্তি এক নয়। আমি দেশ-বিদেশে ঘুরেছি। দেখেছি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভাস্কর্য। ভাস্কর্য একটা শিল্প। একটা দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি তুলে ধরে ভাস্কর্য। আর মূর্তি থাকে উপাসনালয়ে। মূর্তিকে পূজা করা হয়, ভাস্কর্যকে নয়।

মূল বিষয় হচ্ছে, আমরা যে মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করছি, সেই মুহূর্তে ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে। আমি মুক্তিযোদ্ধা। এতে আমি রক্তাক্ত হয়েছি। বলতে বাধ্য হচ্ছি, আজকে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা এভাবে ভাবেন কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্রে তাঁর কাছের লোকও ছিল। খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুর রক্তের সঙ্গে বেঈমানী করে রাষ্ট্রপতি হলো। তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের অনেকেই তখন যুক্ত হয়েছিল। তাদের দু’একজন কিন্তু এখনও রয়েছে। সুতরাং তারা যে আবার ষড়যন্ত্র করবে না এ কথা বিশ্বাস করা যায় না।

বিভিন্ন সময় হেফাজতকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। তারা খুব পরিকল্পনা করে এই সমাজ বিষিয়ে তুলছে। তারা সমাজে পশ্চাৎমুখী ধ্যান-ধারণা ছড়িয়ে দিচ্ছে। এ জন্য ধর্মকে তারা ব্যবহার করছে। এ কৌশল তাদের অনেক পুরনো। অন্যদিকে আমরা নিজেদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করেছি। আমার মনে হয়, কিছু ইস্যুতে সব মুক্তিযোদ্ধার এক হওয়া উচিত। বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা যদি এক হয় তাহলে বঙ্গবন্ধুকে কেন সরকার নিরাপত্তা দিলো না? অনেকে এক সময় বিএনপি করেছে, তারা এই সরকারের আমলে একুশে পদক পাচ্ছে! অথচ অতীত থেকে আমরা এখনও শিক্ষা নিচ্ছি না। এই জিনিসগুলো এখনও অমীমাংসিত থেকে গেছে। আমরা বিজয় উৎসব করছি। আতশবাজি ফুটাচ্ছি। ভবনে আলোকসজ্জা করছি। কিন্তু অন্ধকারের শক্তি, ধর্মের অপব্যাখ্যাকারী, অপসংস্কৃতিকারী, পাকিস্তানি ভাবধারার দোসররা তাদের মতো এগিয়ে যাচ্ছে। সে তুলনায় আমরা পিছিয়েছি। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্য লজ্জা।

 

রাইজিংবিডি : আজ মহান বিজয় দিবস। আপনার অনুভূতি জানতে চাই?

ফকির আলমগীর : লাল-সবুজের উৎসব করতে গিয়ে দুটি বেদনা আমাদের ব্যথিত করে। একটি হলো আমাদের মহান নেতার মৃত্যু। অন্যটি আমাদের অনেক সূর্যসন্তানও আজ আমাদের মাঝে নেই। ১৫ আগস্ট এবং ১৪ ডিসেম্বর আমাদের অনেক সর্বনাশ হয়ে গেছে। এ দুটি বেদনা বিজয়ের আনন্দকে ম্লান করে দেয়। বিজয় আনন্দের, বিজয় উৎসবের। এছাড়াও স্বাধীনতার মহান নায়করা যারা আমাদের মাঝে নেই, তাদের বিয়োগবেদনা আমাদের ব্যথিত করে।

রাইজিংবিডি : যে কারণে যুদ্ধে গিয়েছিলেন সেখানে আপনারা সফল। এরপর?

ফকির আলমগীর : একটা ভৌগোলিক স্বাধীনতার দরকার ছিল। না হলে এদেশের উন্নতি হতো না। আজকের উন্নয়ন, অগ্রগতির মহাসড়কে আমরা যেতে পারতাম না। স্বাধীন বলেই এটা আমরা পারছি। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা-বিরোধীরা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিল। তখন আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। নতুন প্রজন্মের মাঝে ভুল ইতিহাস ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তদের ওভারকাম করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায় এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধগুলোকে আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে। এগুলো শুভ উদ্যোগ। সুতরাং হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আরো সময় লাগবে।

রাইজিংবিডি : নতুন প্রজন্ম স্বাধীনতার চেতনা কতটুকু ধারণ করে বলে আপনি মনে করেন?

ফকির আলমগীর : নতুন প্রজন্মের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা অনেক বেশি। আমরা খুব আশাবাদী। নতুন প্রজন্ম শুধু অপশক্তিকে রুখে দাঁড়ায়নি। শাহবাগ বসন্ত থেকে তেল, গ্যাস আন্দোলনে তারা অনেক ভূমিকা রেখেছে। বুড়োরা কিন্তু বিভ্রান্ত। হাইব্রিড নেতৃত্ব বিপথগামী, বিভ্রান্ত এবং পলায়নপর। নতুন প্রজন্ম খুবই প্রযুক্তি-নির্ভর।

উৎস – রাইজিং বিডি


শর্টলিংকঃ