বাংলার নারী ও সুফি, অথবা ‘নারী সুফি’


বাংলার ইতিহাসে নারী সুফি কি আছেন, নাকি নাই? ইতিহাস ব্যবসায়ীরা মাথা কণ্ডূয়ন করে বলবেন, নাই। কিংবা ভেবে পাচ্ছি না। আচ্ছা, রোসো! এখানে দুইটা বিপরীত অনুমান বলি।অনুমান এক, পুরুষতন্ত্র নারীদের সুফি হতে দেয় নাই, কিংবা সব নারী সুফির নাম মুছে ফেলেছে।অনুমান দুই, নারীরা সুফিবাদে অংশ নিয়েছেন এবং ঠিকই নিজেদের নাম লিখে রেখে গেছেন কোথাও।

প্রথম অনুমান ধরে আগাই প্রথমে। পুরুষতন্ত্র নারী সুফিদের নাম ধামাচাপা দিতে পারে বটে, কিন্তু আমরা তো আসলে দুনিয়ার অধিকাংশ পুরুষ সুফির নামও জানি না। বেশির ভাগ পুরুষ সুফির স্মৃতিও লোকসমাজে জারি থাকেনি, হারিয়ে গেছে। খালক্ব বা জনসমাজে নামযশ এড়িয়ে চলাটা সুফি গুণাবলির অন্যতম। অতএব বহু সুফির মধ্যে নিজের হাজিরা মুছে ফেলার একটা তাগিদ থাকত। যাদের নাম আমরা সুফি হিসেবে জানি তারা হয় নিজেরা লেখালেখি করতেন, কিংবা তাদের সামাজিক উপস্থিতির সাক্ষ্য নিয়ে অন্য কেউ লেখালেখি করেছে। মালফুজাত বা বচনামৃত, মাক্তুবাত বা রচনামৃত, তাজকিরাত বা পবিত্রজীবন, সিলসিলা ও শাজারা, গজল বা রুবাই, এ রকম নানা প্রকরণের লেখনের মধ্য দিয়ে একেকজন সুফির স্মৃতি সংবাহিত হয়ে এসেছে।

যেমন ধরা যাক খাসবিবি বা ‘আবেদা’ ফাৎযাল যাদা নামক এক নারীর স্মৃতি। আবেদা মানে এবাদতপরায়ণা। গিরীন্দ্রনাথ দাস লিখেছেন যে খাসবিবি ছিলেন হজরত আবু বকর সিদ্দিকের বংশধর। তার পূর্বপুরুষ চেঙ্গিস খাঁর আমলে ভারতে এসেছিলেন। দিল্লিতে সম্রাট আকবরের আমলে খাসবিবির জন্ম হয়। এরপর মান সিংহ যখন যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যকে দমন করতে আসেন তখন খাসবিবি সে অভিযানে সহযাত্রী হন। বাংলাদেশে এসে খাসবিবি বসিরহাট মহকুমার বাদুড়িয়া থানার খাসপুর গ্রামে অবস্থান করেন। সেখানেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। জাহাঙ্গীরের আমলে তার নামে লাখেরাজ বা নিষ্কর জমি মঞ্জুর হয়। গিরীন্দ্রনাথের সাক্ষ্যে, খাসবিবি আবদুল গফুর সিদ্দিকীর বংশীয় পূর্বনারী। এ নারীর পুণ্যস্মৃতি বাদশাহি আমল ছাপিয়ে আধুনিক জমানাতেও জারি থাকতে দেখেছেন গিরীন্দ্রনাথ। ‘পীরানী খাষবিবির দরগাহে সেবায়েতগণ কর্তৃক নিয়মিতভাবে ধূপ-বাতি প্রদত্ত হয়। ভক্ত জনসাধারণ সেখানে হাজত মানত শিরনি দেন। পীরোত্তর হিসাবে প্রায় দুই বিঘা জমি পতিত আছে। তাঁর নাম মহিমার জন্য গ্রামের নাম হয়েছিল খাষপুর। স্থানীয় হিন্দু-মুসলিম সকল ভক্তই তাঁর প্রতি সমধিক ভক্তি প্রদশন করেন। তিনি ইসলাম মাহাত্ম্য প্রচারের সহায়ক মানবদরদী ক্রিয়াকলাপের জন্য আজো স্মরণীয় হয়ে আছেন।’

এত লিখেও পরিশেষে গিরীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘তিনি যে সুফী মতাবলম্বী ছিলেন এবং সেই মতবাদ প্রচার করেছিলেন এমন কোন প্রামাণ্য নিদর্শন পাওয়া যায় না।’ অর্থাৎ দরগাহ থাকলেও এবং পুণ্যবতী হিসেবে লাখেরাজের বরাদ্দ পেলেও খাসবিবির নিজস্ব স্বরটি কোথাও সেভাবে হাজির আছে বলে গিরিশ দেখেননি। খাসবিবিকে লোকে আবেদা ও পীরানি বলছেন, কিন্তু তিনি মানুষটি কী ছিলেন? তিনি কি সুফি ছিলেন? লোকে যারে সুফি বলে সেই কি সুফি হয়? বাংলার ইতিহাসে অসীম রায় ও রিচার্ড ইটন দেখিয়েছেন, অনেক সামরিক বা প্রশাসনিক ব্যক্তি বা কল্পিত চরিত্রকে উত্তরকালের লোকে পীর বানিয়েছেন। অসীম রায় একে বলেন পীরিফিকেশন বা পীরায়ন। এই পীরায়নের ক্ষেত্রে ইতিহাসের খাসবিবি কিংবা লোককথার বনবিবিকে বাদ দিলে পীরায়িত নারীর সংখ্যা আসলেই কম। তাহলে পুরুষতন্ত্র হয়তো আসলেই নারী সুফির নাম মুছে ফেলেছে? নাকি নারীরা সুফিই হতে পারেননি? বাংলার সমাজের আম কিংবা এলিট নারীর পক্ষে পীরায়িত হওয়া এবং পীর হিসেবে তাদের স্মৃতির সংবহন কতটুকু সম্ভব ছিল? উপনিবেশপূর্ব যুগে লেখন-সংস্কৃতির পরিসরে নারীর উপস্থিতি আমরা সীমিতই পাই। উপনিবেশপূর্ব বাংলার ইতিহাসে মুসলমান নারী কবির সংখ্যা হিন্দু নারী কবির মতোই বিরল।

কিন্তু এবার আসেন দ্বিতীয় অনুমানে। অধ্যাত্মপ্রবণ মুসলমান নারীরা কি নিজেদের চিহ্ন রেখে যান নাই কোথাও না কোথাও? যাওয়ারই তো কথা। প্রমথ চৌধুরীর একটা উক্তি স্মরণ করি, বাংলা ভাষায় আত্মজীবনী লেখেন শুধু মেয়েরা, তাও পূর্ববঙ্গের। পূর্ববঙ্গ বাদই দেন। পুরা বাংলাই না হয় হিসাব করি। ইংরেজ জমানায় রাসসুন্দরী বলেন, হানা মুলেন্স বলেন, বাংলা লেখালেখিতে নারীর পুরোধাগিরির নমুনা কম না। ফলে নারী সুফির চিহ্ন পাওয়া গেলেও যেতে পারে। একটা আন্দাজ করি, মুসলমান নারী লেখক যেখানে পাব, মুসলমান নারী সুফিও তার আশপাশেই পাব, কারণ লেখা ছাড়া তো স্মৃতি জারি থাকে না। হাফিজ-রুমি-জামি যেমন সুফিকুলে উচ্চঠাঁই পেয়েছেন লেখার গুণে।

দেখা যাচ্ছে, আমাদের এই আন্দাজ ঠিক। উপনিবেশপূর্ব বাংলার ইতিহাসে প্রথম যে নারী কবি আবিষ্কৃত হন তার নাম রহিমন্নিচা (জন্ম ১৭৬০-১৮০০, মৃত্যু অজ্ঞাত)। পঞ্চাশের দশকে ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক রহিমন্নিচার প্রতি সুধীসমাজের, বিশেষ করে পুং সুধীসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। রহিমন্নিচা সুফি বংশীয় ছিলেন, ‘শাস্ত্র’ শিখেছিলেন, ছিলেন ধার্মিক ও ভাবপ্রবণ মানুষ এবং বিস্তর লেখালেখির চর্চা করতেন। এত গুণে গুণী রহিমন্নিচাকে সুফিভাবাপন্ন নারী বললে আশা করি খুব বেশি দোষ হবে না। রহিম নিজেকে অবশ্য সুফি বলেন নাই, কিন্তু যে ব্যাটা বা বেটি নিজেকে সুফি বলে দাবি করেন, তার সুফিত্ব নিয়ে সন্দেহ করাও একেবারে পাপ বলা যায় না, কারণ পরমের সাপেক্ষে নিজের সত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা সুফিবাদের এক মৌলিক মুদ্রা। ফলে রহিম নিজেকে সুফি শায়খা বা পীরানি বলে রটনা করেননি এ যুক্তি তার সুফি হওয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা ঠিক হবে না।

নবাবি আমলে বাংলা বিহার উড়িষ্যা যখন একত্র ছিল, রহিমন্নিচার দাদা তখন ছিলেন মুঙ্গেরের সম্ভ্রান্ত মুসলমান। আরবের কোরাইশ বংশীয় অভিবাসী তারা সে অঞ্চলে। মীর কাসিমের সঙ্গে ইংরেজের যুদ্ধ হলে তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে তিনি চট্টগ্রামে অভিবাসন করেন। সেখানে জংলী শাহ নামে তিনি মানুষকে দীক্ষাদান করতে শুরু করেন। আখেরি মোগল আমলের প্রচলন অনুসারে তিনি চার তরিকায় খেলাফত দান করতেন। তার পুত্র আবদুল কাদেরও ‘ছুপি খানদানে’ সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন ও বহু লোককে শিষ্যত্ব দান করেন। তিন পুত্র ও এক কন্যাকে রেখে আবদুল কাদের যখন মারা যান তখন রহিমের বয়স অতি কম। বাবাহারা অনাথা রহিম হেসেখেলে কাল গোঞাইতে লাগলেন। তখন তার মা আলিমন্নিচা, যিনি ‘অনুপম গুণে’র অধিকারিণী ছিলেন, রহিমন্নিচার শিক্ষার ভার নিলেন, শাস্ত্র পাঠ শেখালেন। বয়সকালে এক সুরসিক বিদ্বান পুরুষের সঙ্গে রহিমের বিয়ে হলো। কিন্তু বিধি বাম। রহিমের ভাগ্য ছিল আজন্ম বিড়ম্বিত। রহিমের জীবনে প্রথমে বাপ, তারপর ছোট ভাই এবং পরিশেষে স্বামীর বিয়োগ ঘটে। একের পর এক এই তীব্র শোকাবহ ঘটনা, এই উন্মূলতার বোধ রহিমকে হয়তো মরজগৎ ও জীবন নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করেছিল।

পুরুষ কবিরা যেমন নিজেদের পরিচয় দেওয়ার ক্ষেত্রে পিতৃপরিচয়, গুরুপরিচয় ও পোষ্টাপরিচয়ে গুরুত্ব দিতেন, রহিমন্নিচাও নিজ পিতা, স্বামী ও গুরুর পরিচয় দিয়েছেন সবিস্তারে। এর পেছনে লেখক হিসেবে নিজেকে পরিচয় করানোর পাশাপাশি নিজের নারীসত্তার সম্ভ্রান্ততা নির্দেশ করার প্রেরণাও থাকতে পারে। নারীশ্রেষ্ঠত্ববাদী নন রহিমন্নিচা, বরং নারী হীন, এ কথা যখন তিনি বলেছেন, ‘স্থিরি জাতি হিনমতি’, সেটা রেটরিকাল আত্মনিন্দা নয়, বরং নারীর বুদ্ধি কম, এ প্রাচীন এরিস্টটলীয় ধারণারই পুনরুৎপাদন। পুরুষের সাপেক্ষেই, পিতা ও স্বামীর সাপেক্ষে, নিজের কুলগৌরব চিহ্নিত করেছেন রহিম।

তবু রহিমন্নিচার জীবনে তার মায়ের প্রভাব খুবই লক্ষণীয়। বিধবা আলিমন্নিচা পুত্রদের পাশাপাশি কন্যাকেও শাস্ত্র পাঠ শেখানোর বন্দোবস্ত করেছেন। অবশ্য পিতা থেকে পুত্রক্রমে যেভাবে সুফি সিলসিলার পরম্পরা সংবাহিত হয়, আলিমন্নিচা থেকে রহিমন্নিচার শিক্ষাদীক্ষার অনুরূপ কোনো সিলসিলায়ন ঘটেনি। মাতা-দুহিতার এ সিলসিলা কোনো স্বতন্ত্র নারী শাজারার জন্ম দেয়নি। তাছাড়া রহিমের বাপ যেমন চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে ঘুরে খেলাফত দিতেন, রহিমের পক্ষে তেমন ঘুরে ঘুরে বা আমদরবার বসিয়ে শিষ্যসামন্তের বিস্তার করা হয়তো সম্ভব ছিল না। শিক্ষিত নারী হিসেবে কি এলাকার নারীদের তিনি উপদেশ-নসিহত দিতেন? ক্ল্যাসিক্যাল ইসলামের যুগে বসরার শাবাকা ছিলেন এক নারী যার বাড়িতে ভূগর্ভস্থ কক্ষে নারীরা একত্র হয়ে তপস্যা, কৃচ্ছ্রতা করত। তেমন কোন নারী জমায়েত কি হতো আলিমন্নিচা বা রহিমন্নিচার বাড়িতে? কে বলতে পারে? বাংলার নারীদেরও তো ছিল নিজস্ব সামাজিকতা, সামাজিক পরিসর, লেনদেন, জ্ঞানকাণ্ড-পরম্পরা-সংবহন। সহি বাত, তবে নারীস্বাতন্ত্র‍্যের ধারণাকেও অতিশায়িত করা ঠিক হবে না। নারীলেখন বা ecriture feminine একটা ধাতবাদী ধারণা। নারী লেখক নিজের কথা কেবল নারীর ভাষায় নারীকেই বলতে চায় তা নয়। শোকসন্তাপে ভরা রহিমন্নিচার জীবন এবং তার লেখালেখিজুড়েই আছে আত্মজৈবনিকতা এবং এ আত্মজৈবনিকতার লেখক ও কাংক্ষিত পাঠক কেবলই নারী নয়, বরং মানুষ বান্দা, তথা Dasein। প্রমথ চৌধুরীর উক্তিটি ফিরে ভাবলে প্রশ্ন আসে, স্বকক্ষবিচ্যুত বা শোকসন্তপ্ত নারীর অভিব্যক্তির একটি রাস্তাই কি তাদের আত্মজৈবনিকতার উৎস?

বলার মতো তেমন কোনো পূর্ণাঙ্গ কাব্য রচনা করেননি রহিম। তিনি আলাওল ও বাহরাম খাঁর কাব্যের অনুলেখন করেছিলেন। তারই মধ্যে তিনি জুড়েছিলেন নিজের আত্মবিবরণী, যার দরুন, খোদা মেহেরবান, তার অসামান্য জীবনকাহিনীটি আমাদের কাছে পৌঁছেছে। রহিম আরো লিখেছিলেন নিজ ভাই আবদুল গফুরের মৃত্যুশোকে ভারাতুর একটি বারমাস্যা। ভাইয়ের শোকে লেখা রহিমের এ বারমাস্যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক স্বতন্ত্র জিনিস। মধ্যকালীন বাংলায় বারমাস্যা সাধারণত প্রিয়ের বিরহে প্রিয়ার হাহাকার প্রকাশ করত, কিন্তু রহিমন্নিচার বারমাস্যাটিকে এনামুল হক একটি এলিজি বা শোকসংগীত বলে অভিহিত করেছেন। এনামুল হকের বরাতে আরো জানা যায়, আত্মবিবরণী ও বারমাস্যা বাদে রহিমের তৃতীয় কবিতা হলো”দোরদানা-বিলাপ, যেখানে দোরদানা নামক এক কন্যাকে পতেঙ্গায় বিয়ে দেয়ার কিছুদিন পরেই স্বামীর নির্যাতনে কন্যাটি নিহত হন। গৃহহিংসায় নিহত কন্যার জন্য তার বাপ-মা-ভাই-বোনের যে বিলাপ তাই কবিতার প্রতিপাদ্য।

রহিমের যে ভাবগত মেজাজ, সেটার সাথে যদি আরব দেশের ক্ল্যাসিক্যাল নারী সুফিদের তুলনা করি, তাহলে দেখব সেকালের আরব নারী সুফিরা উপাসনা ও কৃচ্ছ্রতা, প্রেমমত্ততা (মাহাব্বা), ভয় (খাওফ) ইত্যাদি ভাবাবেগের চর্চা করতেন। করতেন দাস্যভাবের (তাআব্বুদ) চর্চা। বিলাপ (বুকা) তথা ঈশ্ব রস্মরণে বা জিকরে কান্নাকাটি করাটাও ছিল অন্যতম চর্চা। আর দেখুন, রহিমের আত্মানুভবজুড়ে আছে শোকসন্তাপ এবং দীন-অনুচ্চভাব, ‘মুই হিন তিরি জাতি’, ‘মুই অতি খিনমতি দুক্ষিত তাপিত’, ‘ছিরিমতি খুদ্র অতি রহিম ন্যিচা নাম’, ‘মুই হত অভাগিনি’, ‘হিনখিন অল্পজ্ঞান মুই কলঙ্কিনি’ ইত্যাদি। নিজেকে ব্যজনিন্দায় ‘দুষ্ট কলংকিনী’ আখ্যায়িত করা রহিমের আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষার মধ্যে আছে পতিভক্তি ও সতিত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার মধ্য দিয়ে ‘সতীর সমাজে’ স্থান পাওয়া এবং নবীর চরণে নিস্তার লাভ করা।

রহিমন্নিচা স্বমহিমায় ভাস্বর। তবু তার রচনা আমাদের কাছে পৌঁছেছে হয়তো তিনি বিখ্যাত পুরুষ লেখকের রচনা কপি করেছিলেন বলেই। যদি একেবারেই নিজের দস্তখতের ওপর নির্ভর করতেন রহিম, জানি না কতদূর তা সংবাহিত হতো।

রহিমন্নিচার যুগের কিছু পরের আরেকটি উদাহরণ দিই। শ্রীহট্টের ভাটি অঞ্চলের মহাপুরুষ হাছন রাজা। তার সৎবোন ছিলেন ছহিফা বানু বা হাজী বানু (১৮৫৪-১৯১২)। ১৯০৭ সালে তার কবিতা-সংকলন ‘ছহিফা সঙ্গীত’ প্রকাশিত হয়। তার এই সকল গীতে ইসলামি, বৈষ্ণব ইত্যাদি পরিভাষা হাজির। তার লেখা একটি গীত এমন—

সুবল, যা রে বৃন্দাবন

দেখে আস গে রাধারাণী আছেরে কেমন॥

মথুরাতে আছি আমি পাগল আমার মন,

রাধার জন্য সদা আমার প্রাণ উচাটন॥

রাধার পদে ধরে সুবল করিস নিবেদন,

দিবানিশি রাধা প্যারী আছেরে স্মরণ॥

রাধার প্রেমে আছি বান্ধা জন্মের মতন,

শীঘ্র গিয়ে দেখব আমি ঐ রাঙ্গা চরণ॥

মথুরাতে আছি আমি হইয়ে রাজন,

রাধার খেদে ত্যাজ্য করব রাজসিংহাসন॥

ছহিফায় বলে শুন ভুবনমোহন,

কুব্জার কুবুদ্ধিয়ে তুমি হয়েছ বন্ধন॥

পরমের সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক কৃষ্ণ ও রাধার রূপকে ধরেছেন ছহিফা। পারস্য সাহিত্যের ইতিহাস মাথায় রাখলে এহেন রূপকায়ন কোনো আজগুবি ব্যাপার বলে মনে হবে না। বিদুষী আয়েশা ইরানি মুসলমান-সাম্প্রদায়িক ভাবাপন্ন কোনো মুসলমান কবির পক্ষে রাধা-কৃষ্ণের পদ লেখা সম্ভব কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। আমার বুঝমতে, সেটা বিলক্ষণ সম্ভব। আবার পণ্ডিতবর টনি কে স্টুয়ার্ট তর্ক তুলেছিলেন যে রাধা-কৃষ্ণ ইত্যাদি বৈষ্ণব পরিভাষা ব্যবহার করার মানে সমন্বয়বাদ (সিনক্রেটিজম) নয়, বরং এটা মুসলমান মিশনারি কবিদের দ্বারা বাংলার আম শ্রোতামণ্ডলীর পরিচিত পরিভাষা ব্যবহারের দ্বারা ইসলাম প্রচার। আমার মতে ব্যাপারটা অমন সরল নয়। পুরাতন বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে এ রকম লেনাদেনা আদতেই এক ভিন্ন সামাজিক বাস্তবতা ও আধ্যাত্মিক বাস্তবতার চিহ্ন।

ব্যাপারটা বোঝাতে, শ্রীহট্টনিবাসিনী শিক্ষিতা, বড়লোকের কন্যা ছহিফা বানুর রাধা-কৃষ্ণ পদের পাশে আমি স্থাপন করব সুন্দরবনের কাছাকাছি জাপুসা গ্রামের পোদ জাতীয় এক নিরক্ষর বাঙালি নারীর ভাব-গীতি। এ নারীর নাম জানা যায় না, তবে তিনি ‘কবেল কামিনী’ নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। সম্ভবত উনিশ শতকের মধ্যভাগে তার জীবৎকাল। মোক্ষদাচরণ ভট্টাচার্য্য লিখেছেন, কবেলের ভাগ্নে তারাচাঁদ, গাজী গীতের দল নিয়ে গান গেয়ে বেড়াতেন এবং নিজ গুরু হিসেবে মাসির কথা স্মরণ করতেন। কবেলের প্রতিভার সার্টিফিকেট প্রসঙ্গে লোকে বলত, ‘একদিন প্রাতে অমাবস্যা তিথিতে কবেল-বেটী একটী মেটে কলসী লইয়া তাহার পিতৃভূমি জাপুসা গ্রামের দক্ষিণাংশের ‘‘বিরাট’’ নামক গ্রামের খালে জল আনিতে গিয়াছিল, সেই সময় তাহার মুখে ‘‘শ্যামাসঙ্গীত’’ শুনিয়া নিজে নাকি জগজ্জননী শ্যামা তাহাকে “কবেল” উপাধিতে ডাকিয়া আশীৰ্বাদ করিয়াছিলেন।” দেখা যাচ্ছে, কবেল যে আরবি শব্দ, তাতে শ্যামা মায়ের এই উপাধি আমল করতে আটকায় নি। তো এই পোদকন্যা কবেল বেটি কেবল শ্যামা বা রাধার গান বাঁধতেন না, তিনি গাজীপীরের গানও বাঁধতেন। একটি ভণিতা এমন—

‘পরগণে হোগলার মধ্যি গ্ৰাম জাপুসা।

গীত গড়িয়ে গারস্তালি করে কবেল মা।।’

খুব একটা বোঝা গেল না মোক্ষদাচরণের দেয়া এ উদাহরণ থেকে। যে মুখে-মুখে ছড়ানো গাজীর গীতের আর্কাইভে কবেল বেটি নিজের স্বাক্ষর রেখে গেছিলেন, সেটা ভদ্রলোকেরা ততটা সংরক্ষণ হয়তো করে উঠতে পারেননি। ফলে কবেল বেটির মুখে রচিত গাজীপীরের গান কেমন ছিল সে পরিচয় আমার বিস্তারিত জানা নেই। তবু নারী সুফির আলাপে পোদবংশীয় কবেল বেটির আলাপ টানলাম এ কারণে যে বাংলার আমসমাজে গাজীপীর বনবিবি ইত্যাকার যে পীরবাদের আমল হয়, সেখানে নারীর সৃষ্টিশীল অংশগ্রহণ ছিল এবং উপনিবেশ আমলে গঠিতব্য ‘হিন্দু সমাজে’র নিচু জাতের নারীও এই চিত্ররূপময়-সাকারবাদী-কাহিনীনির্ভর অধ্যাত্ম সাহিত্যে দুই ফোঁটা শিশির ট্রিবিউট দিতেন বৈকি! শিশিরের এ রূপককে কেউ ফ্যালোসেন্ট্রিক ভাবতে চাইলে ভাবুন। আমার বক্তব্য শুধু এই যে গাজীর কাহিনী সুফিবাদ তথা ইসলামের ভাবসম্পদেরই রূপবিশেষ।

আর্কাইভ বা চিহ্নশালায় নিজের স্বাক্ষর আলগোছে রেখে যাওয়ার ফলে এমন কিছু নারীর খবর আমরা জানতে পেরেছি। আরেক ধরনের স্বাক্ষর ছিল মসজিদ-মাদ্রাসা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করে, তার শিলালিপিতে নিজের নাম জারি করা। পুরুষ সুফিদের পাবলিক ধর্মকর্মের এক বড় অংশ যেমন ছিল সমাজ বা কমিউনিটি প্রতিষ্ঠার নানা উদ্যোগ, তা চাষবাস, মসজিদ-মাদ্রাসা, কিংবা যুদ্ধ, যার মধ্য দিয়েই হোক, তেমনি পুণ্যপ্রত্যাশী নারীরাও সমাজ গঠনের পরিসরিক আমল হিসেবে নানা রকম স্থাপনা কর্মে জড়াতেন বলে জল্পনা করা যায়। বিনত বিবি কিংবা মালতী, সুলতানি আমলে এ ধারার সূচনা করেন বটে, তবে আখেরি-আঠারো শতক এবং উনিশ শতকে এ ধারা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায়। অনেকানেক সম্পদশালী নারী ধর্মীয় স্থাপনা কায়েম করেন। শিলালিপিতে নয়তো জনশ্রুতিতে তাদের নাম আমরা পাই। এসব শিলালিপিতে প্রায়ই পাওয়া যায় অধ্যাত্মবোধের সুমিত অভিব্যক্তি। যেমন ১৮৭০ সালে নবাবগঞ্জের বক্তারপুরের সাহেববাড়ির মসজিদটি ফয়জুন্নেসা নামক ধনাঢ্য নারী নির্মাণ করেছিলেন এবং তার কারণ হিসেবে শিলালিপিতে লেখা, ‘স্বর্গলোকের ভাগীদার হতে অকপট বিশ্বাসে, বানালেন প্রেমময় মসজিদ একখানা, যেন দিনে পঞ্চবার অনন্তের পানে প্রার্থনার দ্বারা চিরকল্যাণের সাধন হয় পাকা।’ (আমার পাঠ ও অনুবাদ-চেষ্টা)। কথাগুলোর মধ্যে সুফিবাদের শাস্ত্রীয় বা পারিভাষিক চিহ্ন নেই। তবে আছে আধ্যাত্মিক বোধ, প্রেম এবং সমাজ গঠনের উদ্যোগ।

ওপরের এই ছাড়া-ছাড়া আলোচনার উদ্দেশ্য জোর করে এটা প্রমাণ করা নয় যে নারীদের মধ্যেও পুরুষের সমান বড় বড় সুফি ছিলেন। নারীর পক্ষে কি তরিকতের পীর হওয়া সম্ভব ছিল? কিংবা মনসুর হাল্লাজ বা সারমাদের মতো ফকির হয়ে জালালি জুনুনের (সাবলাইম ম্যাডনেস) আমল করা কি নারীর পক্ষে সম্ভব ছিল? জানি না। সুফি পরিচয়ের যে প্রকাশ্য লীলাময়তা (পাবলিক, পারফরমেটিভ দিক) সেটা আমল করার ক্ষেত্রে নারীদের যেমন জোরদার অংশগ্রহণ ছিল, আবার বাধানিষেধও ছিল। যেমন দিল্লির ফিরুজ শাহ তুঘলক নারীদের মাজার গমন নিষিদ্ধ করেছিলেন। অর্থাৎ সুফিবাদের প্রকাশ্য লীলাময়তার আমলে নারীরা একটু বেশি অসুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন। মোটকথা, বাংলায় অনেক বড় বড় নারী সুফি ছিলেন, এটা আমার বক্তব্য নয়। বরং ইতিহাসে সুফিবাদের আমল বোঝার পদ্ধতির দিক থেকেই আমার বিবেচনা হলো এই যে মহাপুরুষকেন্দ্রিক আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ হলেও সুফিবাদকে প্রকৃত ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে বুঝতে হলে তার চিহ্নতন্ত্র, পরিসরিক আমল, স্মৃতি-বিস্মৃতি-নির্মিতি ইত্যাদি বিবেচনা করা জরুরি। নারী সুফিদের ইতিহাস আমরা জানি না বটে, কিন্তু সম্ভবত উপরোক্ত পদ্ধতিতেই রুহানি চর্চায় নারীর অংশগ্রহণকে বোঝার কাজে প্রথম পা বাড়ানো সম্ভব।

তাহমিদাল জামি: লেখক ও গবেষক; সমন্বয়ক, বেঙ্গল হিস্ট্রি কালেক্টিভ (বেহিকা)

 


শর্টলিংকঃ