বুঝেশুনে সৌদি যান


ইউএনভি ডেস্ক:

আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে তেল বিক্রি বন্ধ করে দেয় সৌদি আরব ও তার প্রতিবেশীরা। পানির দরে বিকানো তেলের দাম জ্বালানি অবরোধের কারণে আকাশ স্পর্শ করে। ফুলে-ফেঁপে ওঠে সৌদির রাজকোষ। শুরু হয় দেশটির উন্নতির গল্প। ঝকঝকে সড়ক, আকাশচুম্বী দালান নির্মাণের হিড়িক শুরু হওয়ায় ডাক পড়ে বিদেশি কর্মীর। তাতে শামিল হন বাংলাদেশিরাও।

বুঝেশুনে সৌদি যান

আশির দশকের শুরু থেকে দলে দলে বাংলাদেশি সৌদি প্রবাসী হন। সেই সময়ে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকায় দেশটিতে গিয়ে দুই মাসের বেতনেই খরচ উঠত। শুধু শ্রমিক নয়; চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারীরাও পাড়ি জমান মরুর দেশে। ভালো উপার্জনের আশায় ‘সৌদি ড্রিম’ তৈরি হয় বাংলাদেশে। সেই ‘সোনার লংকা’ আর নেই।

১৩ ফেব্রুয়ারি পবিত্র নগরী মদিনা থেকে বদর প্রান্তরে যাওয়ার পথে বাসের পাশের আসনে বসে সৌদি প্রবাসী বাঙালিদের সেই সুখের দিনগুলোর গল্প শোনালেন মুছা জলিল ছৈয়াল। ৩২ বছর আগে তিনি শরীয়তপুর থেকে সৌদি গিয়েছিলেন। আজ তিনি ৬৫ বছরের প্রৌঢ়। খুব কাছ থেকে দেখেছেন বাঙালির সুদিন থেকে দুর্দিন। দিনে দিনে কী করে ফিকে হয়েছে সৌদির স্বপ্ন।

বঙ্গবন্ধু পরিষদের মদিনা শাখার সভাপতি মুছা জলিল ছৈয়াল গান্ধর গ্রুপের হিসাব নির্বাহী। তিনি জানালেন, সৌদিতে আর আগের দিন নেই। বিশেষ করে যারা গত পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে দেশটিতে এসেছেন, তাদের অবস্থা খুবই খারাপ। মদিনা শহরেই অনেক বাংলাদেশির বৈধ ওয়ার্ক পারমিট (আকামা) নেই। আকামা থাকলেও যে কাজের জন্য সৌদিতে এসেছিলেন, সেই চাকরি নেই। অবৈধ হয়ে পড়েছেন।

লুকিয়ে কাজ করেন। সব সময় তারা ধরপাকড়ের আতঙ্কে থাকেন। চার থেকে আট লাখ টাকা খরচ করে সৌদি এসে ১৫-২০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করছেন। থাকা-খাওয়াতেই তা শেষ। দেশে ফেরার সময় কপর্দকশূন্য পকেট।মুছা জলিল আরও জানালেন, দুই কারণে এই অবস্থা। প্রথমটা হলো- সৌদি সরকারের নীতিতে পরিবর্তন। অর্থনৈতিক চাপে থাকা দেশটি বিদেশি কর্মী কমাতে চায়।

২০৩০ সালের মধ্যে সব খাতে দেশি কর্মী নিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। বাংলাদেশিরা খারাপ থাকলেও ভারতীয়, পাকিস্তানিসহ বাকি বিদেশিদের দিন এখনও ভালো কাটছে। বাংলাদেশিদের খারাপ দিনের জন্য দ্বিতীয় যে কারণটি দায়ী, সেই কারণটি হলো- বাংলাদেশ থেকে কর্মী পাঠাতে দুর্নীতি ও সিন্ডিকেট।

সৌদিতে মন্দা থাবা বসালেও বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো সৌদির দালালদের কাছ থেকে ভিসা কিনে দেদার কর্মী পাঠাচ্ছে। সৌদি স্বপ্নে বিভোর এসব নতুন কর্মী এসে পড়ছেন অথৈ সাগরে। চাকরি না পেয়ে পথে পথে ঘুরছেন। দেশেও ফিরতে পারছেন না- কারণ তারা ঋণ করে, জমি বিক্রি করে এসেছেন।আলাপ চলাকালেই মুসা জলিলের হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ এলো- ‘আগামী দুই সপ্তাহ প্রবাসী গাড়িচালকদের ওপর ধরপাকড় চলবে।’

পুলিশ যাকে যেখানে পাবে, সেখান থেকেই তাকে দেশে ফেরত পাঠাবে। মুছা জলিল এ মেসেজ পাঠিয়ে দিলেন তার পরিচিত বাংলাদেশিদের। এসব মেসেজের কতটা সত্যি আর কতটা গুজব তা যাচাইয়ের সুযোগ মিলল না। কারণ জের-জবরহীন আরবি পাঠোদ্ধার সম্ভব হলো না।মদিনার মসজিদে নববি থেকে উহুদের পাহাড় পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশের দোকানপাটে বাংলা ভাষার সাইনবোর্ড খুবই মামুলি ঘটনা।

এদিক-ওদিক উড়ছে লাল-সবুজ পতাকা। বাংলাদেশ হজ মিশনের ঠিক বিপরীতে একটি খাবারের দোকানের নাম ‘রূপসী বাংলা’। যেখান থেকে হাঁটাপথের দূরত্বে ভাতের হোটেলের নাম শেরাটন ও সোনারগাঁও। ‘রূপসী বাংলা’য় কথা হয় জয়পুরহাটের আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। ১১ বছর ধরে সৌদিতে তিনি। আনোয়ারের গল্প অধিকাংশ প্রবাসী বাংলাদেশির মতোই।

নাউক্রি গালফ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে তিনি চাকরি করেন। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন হোটেলে পরিচ্ছন্নতাকর্মী সরবরাহ করে। সেখানে আনোয়ার হোসেনের মাসিক বেতন ৮০০ রিয়াল। যা মাত্র ১৮ হাজার ৪০০ টাকার সমপরিমাণ! এ টাকায় দেশে থাকা তার পাঁচ সদস্যের পরিবার, স্কুলপড়ূয়া তিন সন্তানের পড়ালেখার খরচ চলে না। তাই আট ঘণ্টা ক্লিনারের কাজ শেষে ‘রূপসী বাংলা’য় আবার আট ঘণ্টা ওয়েটারের চাকরি করেন।

এ চাকরি থেকে এক হাজার ১০০ রিয়াল পান আনোয়ার হোসেন। দুই চাকরিতে দিনে ১৬ ঘণ্টা কাজের পর ঘুমানোর জন্য চার ঘণ্টাও সময় পান না। দীর্ঘদিনের অনিদ্রায় চোখের নিচের কালো দাগ স্থায়ী হলেও অনন্যোপায় আনোয়ার হোসেন। তিনি জানান, এমন দুর্দিন ছিল না। বছর পাঁচ-সাতেক আগেও ক্লিনারের কাজে মাসে এক হাজার ৬০০ রিয়াল পেতেন। ওভারটাইমে মিলত আরও ৪০০ থেকে ৫০০ রিয়াল। বাড়িতে দেড় হাজার রিয়াল পাঠাতে পারতেন।

মক্কায় দেখা হওয়া ফরিদপুরের চরভদ্রাসনের আরিফ হোসেন অবশ্য সৌদিতে সুখের দিন দেখেননি। তিনি বছর দুই আগে দেশটিতে এসেছেন। দেশে থাকতে পেঁয়াজ চাষ করতেন। পরপর দু’বার দাম না পেয়ে লোকসানে পড়ে চার লাখ টাকা ধারদেনা করে প্রবাসী হন। এবার পেঁয়াজের দাম আকাশছোঁয়া শুনে খুব আক্ষেপ করলেন- “ক’টা বছর আগে এ দাম থাকলে কি সৌদিতে আসতে হয়! এই দ্যাশে মাইনষে আসে!” বলে কাকে শাপ দিলেন কে জানে।

২৪ বছরের তরুণ আরিফ ঠিক কী চাকরি নিয়ে সৌদি এসেছিলেন, তা তিনি নিজেও জানেন না। বললেন, গ্রামের দালাল তাকে কাকরাইলের এক অফিসে নিয়ে গিয়েছিল। তারা বলেছিল ‘ফ্রি ভিসা’য় তাকে বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। যে কোনো চাকরি করতে পারবেন। কিন্তু সৌদির আইনে ‘ফ্রি ভিসা’ বলে কিছু যে নেই তা জানা ছিল না আরিফের।
সৌদি আসার পর কয়েক মাস দোকানে বিক্রয়কর্মীর কাজ করেন। মাথায় চার লাখ টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে ৬০০ রিয়ালের ওই চাকরিতে টিকে থাকা অসম্ভব ছিল। মালিক বাংলাদেশি হলেও তারও কিছু করার ছিল না। আরিফের জন্য মাসে ৮০০ রিয়াল আকামার ফি গুনতে হচ্ছিল তাকে। যে সৌদি নাগরিকের অধীনে আরিফের আকামা হয়েছিল, তাকেও মাসে চারশ’ রিয়াল ‘ফয়দা’ দিতে হচ্ছিল।

এদিকে বাড়ি থেকে প্রতিনিয়ত চাপ আসছিল ঋণ পরিশোধের, তাই একদিন কাজ ছেড়ে অবৈধ অভিবাসী হয়ে যান আরিফ। এখন যা কাজ পান তাই করেন। আরিফের জিজ্ঞাসা- ‘তেরো হাজার টাহার চাকরি করলে দ্যাশে গেরস্তি কী দোষ করছিল! এর চেয়ে বেশি টাকা তো ক্ষেতখামার করলিও পাওয়া যায়।’ আরিফ জানেন, বিনা অনুমতিতে কাজ পরিবর্তন করায়, আকামা নবায়ন না করায় তাকে যে কোনো সময় পুলিশ ধরে দেশে ফেরত পাঠাতে পারে। বীতশ্রদ্ধ এই তরুণ আর ধরা পড়ার পরোয়া করেন না। তার কথা- যা হওয়ার হবে। ক্ষতি যা হওয়ার হয়েছে। আর কেউ যেন সৌদিতে পাড়ি না জমায়।

পবিত্র শহর মক্কার মিজফালাহ থেকে কাবা শরিফের দূরত্ব বড়জোর এক কিলোমিটার। নাক বরাবর সোজা রাস্তাটি দিনরাত কোলাহলে মুখর থাকে ওমরাহ পালনে আসা যাত্রীর ভিড়ে। লাখো মানুষের চলার এ পথের দু’পাশের দোকানে ঝলমলে পসরা। তার আলোয় দেখা মেলে ম্লান মুখের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের। ‘বলদিয়া’ নামে পরিচিত মক্কা নগর কর্তৃপক্ষের নিয়োগ করা প্রতিষ্ঠান সেডর গ্রুপের কর্মী তারা। প্রায় শতভাগ পরিচ্ছন্নতাকর্মীই বাংলাদেশি।

ইজিপ্ট হোটেলের সামনে কথা হয় টাঙ্গাইলের এক যুবকের সঙ্গে। তিনিও সেডর গ্রুপের কর্মী। রাস্তা পরিস্কারের পাশাপাশি বোতলগুলো বস্তায় ভরছিলেন তিনি। বিদেশে এসে টোকাইয়ের কাজ করে স্বদেশি সাংবাদিকের কাছে ‘ধরা’ পড়ায় কুণ্ঠায় নিজের নাম বলতে চাইলেন না। বললেন, এক কেজি বোতলের দাম ১৫ রিয়াল। সারাদিনে কেজিখানেক বোতল জমাতে পারেন। মাসে ৮০০ রিয়ালের বেতনের সঙ্গে টোকাইয়ের কাজ করে আরও ৪০০ থেকে ৫০০ রিয়াল যোগ হয়। রাস্তার আশপাশের হোটেলে ফুটফরমাশ খাটেন। তাই দিয়ে কোনোক্রমে নিজে চলে বাড়িতে মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পাঠাতে পারেন।

মক্কায় কথা হয় সৌদিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহর সঙ্গে। তিনি জানালেন, অবস্থা ভালো নয়। সেডর গ্রুপের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানটিতে ৩২ হাজার বাংলাদেশি পরিচ্ছন্নতাকর্মী কাজ করতেন। আগে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিটি দলে একজন সুপারভাইজারের অধীনে ১৬ জন কর্মী থাকতেন। অটোমেশনের পর ছয়জন কর্মী লাগছে। কাজের সুযোগ কমে গেছে। সৌদি সরকার বিদেশি কর্মীদের আকামা নবায়নে করারোপ করেছে। তাই প্রতিষ্ঠানগুলোও বেতন কমিয়ে দিয়েছে। তারা বিদেশি কর্মী রাখতে চাইছে না।

কূটনীতিকরা রাখঢাক করলেও, সাধারণ প্রবাসীরা বলছেন- নতুন করে যারা সৌদি আসবেন, তারা যেন ভেবেচিন্তে আসেন। চাকরির নিশ্চয়তা ছাড়া তিন থেকে চার লাখ টাকা খরচ করে কেউ যেন এই দেশে না আসেন। কিন্তু বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো তা কানে তুললে তো।প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, গত বছর সৌদিতে তিন লাখ ৯৯ হাজার বাংলাদেশি গেছেন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে গেছেন ৫১ হাজার ৭৮৬ জন। নতুন করে যারা যাচ্ছেন, তাদের কেউ তিন লাখ টাকার কমে দেশটিতে যেতে পেরেছেন, ঢাকা ও জেদ্দা বিমানবন্দরে এমন কারও দেখা পাওয়া যায়নি।

২৭ বছর আগে দেশটিতে প্রবাসী হওয়া শেখ আনোয়ার এখন জেদ্দায় প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তিনি জোনাকি ট্রাভেলসের মালিক। বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয় তার প্রতিষ্ঠান। তিনি বললেন, নতুন চাকরির সুযোগ কম, কিন্তু তাকেও তো ব্যবসা করতে হবে। প্রতিমাসে আকামার কর, ‘ফয়দা’ দিতে হয়।রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার সভাপতি বেনজির আহমেদ বলেন, এজেন্সি তো কাউকে জোর করে বিদেশ পাঠায় না। কর্মীরাই বিদেশ যেতে মরিয়া। এর সুযোগ নিয়ে হয়তো কিছু কিছু এজেন্সি বাড়তি টাকা নিচ্ছে।

২০০৯ সাল থেকে ছয় বছর দেশটিতে সীমিতসংখ্যক কর্মী যান। ২০১৫ সাল থেকে বড় সংখ্যায় নিয়োগ শুরু হয়। ২০১৭ সালে এক বছরেই পাঁচ লাখ ৫১ হাজার বাংলাদেশি দেশটিতে যান। সৌদিতে কর্মী পাঠাতে সরকার নির্ধারিত ব্যয় এক লাখ ৬৫ হাজার টাকা হলেও সেই সময়ে কর্মীপ্রতি আট লাখ পর্যন্ত নেয় এজেন্সি ও দুই দেশের দালাল চক্র। সৌদির নিয়োগকারীকে ১৫ থেকে ২০ হাজার রিয়াল পর্যন্ত দিয়ে ভিসা ‘কেনাবেচা’ হয়। ওই সময়ে দেশটিতে আসা কর্মীরা বলেছেন, সেই জের তারা এখনও টানছেন।


শর্টলিংকঃ