যুদ্ধদিনের চলচ্চিত্রে ’৭১-এর কথা


ইউএনভি ডেস্ক:

বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মানুষের কাছে এক পরম প্রাপ্তির নাম ‘স্বাধীনতা’। পশ্চিম পাকিস্তানি দখলদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অজস্র জীবনের বিনিময়ে এ স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে। নিঃসন্দেহে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষের হূদয়ের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আখ্যান। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাই এ সময়কাল নানা আঙ্গিকে ইতিহাসের আদলে বয়ে চলছে।

একাত্তরের যুদ্ধের সময় যেসব চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল তার বেশির ভাগের দৃশ্য ধারণ করা হয়েছিল দেশের ভেতরে। আর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সে সময় দেশের ভেতরে ছবি তৈরির যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা তখন একেবারেই সম্ভব ছিল না। এজন্য সম্পাদনা পর্যায়ের কিছু কাজ হয় দেশের বাইরে। তবে মুক্তিযুদ্ধকালে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য একটি পৃথক বিভাগ সৃষ্টি করা হয়েছিল। এর প্রধান ছিলেন নির্মাতা আবদুল জব্বার খান।

পাশাপাশি প্রবাসী সরকার চলচ্চিত্র নির্মাণে অর্থায়নও করেছিল। মোটাদাগে বাংলাদেশ, ভারত, ফ্রান্স, জাপান, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ চলচ্চিত্রগুলোর অধিকাংশ নির্মিত হয়। বাংলাদেশ ও ভারতের সরকারি উদ্যোগ ছাড়াও ব্যক্তি উদ্যোগে ব্রিটিশ, ফরাসি, জাপানি ও আমেরিকান টেলিভিশন সংস্থা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিল।

মুক্তিযুদ্ধকালের ছবির মধ্যে নির্মাতা জহির রায়হান নির্মিত স্টপ জেনোসাইড অগ্রগণ্য। এছাড়া এ সময় ভারত সরকারের অনুদানে নির্মিত হয়েছিল রিফিউজি ৭১, নাইন মান্থস টু ফ্রিডম ও লুট অ্যান্ড ডাস্ট নামের তিনটি ছবি। ভারতে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে চলচ্চিত্র গবেষক মো. নজরুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ও বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেন, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল ভারতে।

এগুলো হলো বাংলা ভাষায় নির্মিত কলকাতার উমা প্রসাদ মৈত্রের জয় বাংলা, বোম্বের আইএস জোহরের নির্মিত হিন্দি ভাষায় জয় বাংলাদেশ এবং সুকদেবের নাইন মান্থস টু ফ্রিডম, ঋতিক ঘটকের দুর্বার গতি পদ্মা, গীতা মেহতার ডেটলাইন বাংলাদেশ ও দুর্গা প্রসাদের দুরন্ত পদ্মা।’ এর মধ্যে জয় বাংলাদেশ ছবিটিতে অভিনয় করেছিলেন বাংলাদেশের অভিনেত্রী কবরী। যদিও ছবিটিতে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক প্রতিফলন ঘটেনি বলে বাংলাদেশ সরকারের আপত্তির মুখে ভারত সরকার ছবিটি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে।

প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে সাদা-কালো ফরম্যাটে নির্মিত হয়েছিল ৯ মিনিট দৈর্ঘ্যের কিছু উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র। এর মধ্যে রয়েছে আলমগীর কবির ও বাবুল চৌধুরীর লিবারেশন ফাইটার্স, জহির রায়হানের আ স্টেট ইজ বার্ন ও বাবুল চৌধুরীর ইনোসেন্ট মিলিয়নস। অন্যদিকে বিদেশী উদ্যোগে নির্মিত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে মেজর খালেদ’স ওয়ার, ডেটলাইন বাংলাদেশ, এ কান্ট্রি মেড ফর ডিজাস্টার। এছাড়া জাপানের টিভি চ্যানেলের উদ্যোগে ১৯৭২ সালে নাগিসা ওশিমা নির্মাণ করেন রহমান, ফাদার অব বেঙ্গল ছবিটি।

জাপানের চলচ্চিত্র নির্মাতা নাগিসা ওশিমা আরো নির্মাণ করেছিলেন বাংলাদেশ স্টোরি নামের একটি ছবি। এছাড়া বিবিসি, এনবিসি, ফরাসি টিভি, সিবিএসের মতো বিদেশী টেলিভিশনের প্রতিনিধিরা মুক্তিযুদ্ধের খণ্ড খণ্ড দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করে নির্মাণ করেছেন প্রামাণ্যচিত্র। যদিও ছবিগুলো সে অর্থে জনগণের সামনে আসেনি। এমনকি এগুলো সংগ্রহে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগও নেয়া হয়নি।

অন্যদিকে স্বাধীনতার পর পরই আলমগীর কবির মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক যেসব স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ, টুওয়ার্ড গোল্ডেন বাংলা, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ও বাংলাদেশ ডাইরি।

মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং এর পর পরই যেসব চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল তার মধ্য থেকে কয়েকটি নিয়ে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হলো:

স্টপ জেনোসাইড

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত ঘটনাবলিকে ধারণ করে যেসব চলচ্চিত্র নির্মিত হয় সেগুলোর মধ্যে প্রথমটি নির্মাণ করেছিলেন জহির রায়হান; নাম স্টপ জেনোসাইড। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সামাজিক অঙ্গীকার গ্রন্থের ১৯৮৭ সংস্করণের ৬৯ পৃষ্ঠায় চিন্ময় মুৎসুদ্দী ছবিটি সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করার ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা নেয়ার জন্য বিশ্ববিবেকের প্রতি আহ্বান ছিল স্টপ জেনোসাইড ছবিতে। কিন্তু এটাই ছবির একমাত্র বক্তব্য নয় এবং সেখানেই আমরা দেখি জহির রায়হানের গভীর অন্তর্দৃষ্টি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে তিনি দেখেছেন পৃথিবীর মুক্তিকামী সকল মানুষের দুর্জয় সংগ্রামের একটি অংশ হিসেবে।’

ছবিটি নির্মাণের ব্যয়ভার বহন করেছিল কলকাতার বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি। ছবিটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল ৭০ হাজার রুপি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকারকে উপহার হিসেবে প্রদান করা হয় ছবিটি। ছবিটি শুধু বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামী মানুষের প্রতিচ্ছবিই নয়, সারা পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের মুখচ্ছবি হয়ে উঠেছিল।

নাইন মান্থস টু ফ্রিডম

স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার ক্ষেত্রে এ দেশের মানুষের শক্তিশালী মনোবল ও সাহস এবং এর বিপরীতে পাকিস্তানি শাসকদের বর্বরতা আর হীনম্মন্যতাকে তুলে ধরা হয়েছে ছবিটিতে। পাশাপাশি এতে অনেক ঐতিহাসিক দলিলও তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখানো হয়েছে শরণার্থী শিবিরে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী কলেরার মতো রোগ ও শিশুদের পুষ্টিহীনতার শিকার হওয়ার বিষয়টি। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে নিঃস্ব অবস্থায় দীর্ঘ পথ হেঁটে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরায় আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতাকেও ছবিটিতে তুলে ধরেছিলেন নির্মাতা এস সুকদেব।

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে

পাকিস্তানি শাসকদের জঘন্যতা কতটা বিকৃত হতে পারে এবং তারা কীভাবে সাধারণ মানুষের ওপর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তা এ ছবিতে তুলে ধরেছেন আলমগীর কবির। ঢাকা প্রকৌশল মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. নুুরুল্লাহর ব্যক্তিগত ভিডিও ক্যামেরার সাহায্যে নিজের ঘরের জানালা দিয়ে ধারণ করেছিলেন। তিনি ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের মাঠে ২৬ মার্চের সকালে হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য। মূলত সেই দৃশ্যগুলোকে অবলম্বন করেই আলমগীর কবির বানিয়েছিলেন চলচ্চিত্রটি। এমনকি অ্যান্থনি মাসকারেনহাস পাকিস্তানি বাহিনীর সুপরিকল্পিত নৃশংসতার যে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিলেন তাও উঠে এসেছে এতে।

ডেটলাইন বাংলাদেশ

পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের শিকার গুলিবিদ্ধ মানুষের মৃত্যুযন্ত্রণা ও হাজার হাজার লাশের চিত্র উঠে এসেছে গীতা মেহতার এ ছবিতে। রয়েছে ভারতগামী শরণার্থীর স্রোত ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পাকিস্তানি প্রচারযন্ত্রের অপপ্রচারের চিত্র। প্রামাণ্যচিত্রটির গুরুত্বপূর্ণ উপস্থাপনাটি হলো ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটি সাক্ষাৎকার। যাতে তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তানি গণহত্যার, ধ্বংসযজ্ঞ ও লাখ লাখ শরণার্থীর দুর্দশার চিত্র।

রিফিউজি ৭১

বাংলাদেশ থেকে শরণার্থীদের যে স্রোত ভারতে গিয়েছিল এবং সেখানে তাদের কষ্টসাধ্য জীবনযাপনের সরল চিত্র তুলে ধরা হয়েছে ছবিটিতে। এটি নির্মাণ করেন বিনয় রায়। শুধু খাদ্য, বাসস্থানের মতো বিষয়ের তীব্র সংকট নয়, নানাবিধ রোগও যে নিরীহ এ মানুষদের মৃত্যুর আরেকটি কারণ ছিল, তা তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে মাদাম তেরেসার অবস্থানের গুরুত্বপূর্ণ দলিল ধারণ করে আছে প্রামাণ্যচিত্রটি।

ইনোসেন্ট মিলিয়নস

যুদ্ধকালে শিশুরা যে কত অসহায়ত্বের মধ্যে থাকে, নিষ্পাপ এ প্রাণগুলোও যে শাসকদের নৃশংসতার ছোবলে পরিণত হতে পারে, সে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে ছবিটিতে। পাক হানাদার কর্তৃক শিশুদের লাশ স্তূপ করে রাখার এ দৃশ্য আছে ছবিটিতে।

লিবারেশন ফাইটার্স

মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মতৎপরতা তুলে ধরা হয়েছে এ প্রামাণ্যচিত্রে। মুক্ত অঞ্চলের দৃশ্য তুলে ধরে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ যুদ্ধ এতে তুলে ধরা হয়েছে। দেখানো হয়, অপারেশনের উদ্দেশে রওনা হওয়া মুক্তিযোদ্ধা দলকে। আগস্টের খারাপ আবহাওয়ার মধ্যে দেশের জলাভূমিতে পাকিস্তানি সৈন্যদের নাকাল হওয়ার দৃশ্যও দেখানো হয়েছে এতে।

মেজর খালেদ’স ওয়ার

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দলিল ভানিয়া কেউলে নির্মিত ছবি মেজর খালেদ’স ওয়ার। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার তৎকালীন মেজর খালেদ মোশাররফ এবং তার বাহিনীর রণাঙ্গনের তৎপরতা তুলে ধরা হয়েছে প্রামাণ্যচিত্রটিতে। সিলেট, কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলে বিস্তৃত তার আওতাধীন এলাকার যুদ্ধ তৎপরতার দৃশ্যাবলি সরেজমিনে তুলে আনা হয়েছিল এতে। রয়েছে মেজর খালেদ ও ক্যাপ্টেন সালেক চৌধুরীর সাক্ষাৎকারও।

রুবেল পারভেজ

তথ্য সহায়ক গ্রন্থ: মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র, খন্দকার মাহমুদুল হাসান


শর্টলিংকঃ