সৌদি আরব থেকে ফিরলেন সেই সুমি


সৌদি আরবে নিয়োগকর্তার নির্যাতনের শিকার হয়ে ফেসবুকে জীবন বাঁচানোর আকুতি জানানো সেই সুমি আক্তার ফিরেছেন। তার ওই আকুতির ভিডিও ভাইরাল হলে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। শেষ পর্যন্ত শুক্রবার সকালে তাকে বহনকারী বিমানটি হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের পরিচালক উপসচিব জহিরুল ইসলাম তাকে স্বাগত জানান। আনুষ্ঠানিকতা শেষে কঠোর গোপনীয়তায় টার্মিনাল-১ দিয়ে কল্যাণ বোর্ডের ব্যবস্থাপনায় তাকে পঞ্চগড়ে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়।

শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৪টায় সুমিকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেন পঞ্চগড়ের বোদার ইউএনও সৈয়দ মাহমুদ হাসান।মেয়েকে ফিরে পেয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলেছেন মা মলিকা বেগম। বলেন, মেয়েকে দেখে শান্তি লাগছে।এ সময় সুমি বলেন, আমাকে ফেরত আনার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই।

প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন সুমির মাও। তবে বিমানবন্দরে হাজির থাকার পরও নুরুল ইসলাম তার স্ত্রী সুমির দেখা পাননি। দেখা পাননি সাংবাদিকরাও।বৃহস্পতিবার রাতেও সৌদি আরব থেকে ফিরেছেন আরও ৮৬ কর্মী।

সুমিকে অন্যপথ দিয়ে বের করা নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে কল্যাণ বোর্ডের পরিচালক জহিরুল ইসলাম বলেন, আসলে বিষয়টা তা নয়। সুমি দেশে ফেরার আগে আমাদের চিঠি দিয়ে জানান যে, তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এর কারণ কী আমি ঠিক জানি না। আমি সুমির সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি ঠিকমতো কথাও বলতে পারছেন না। তাকে ভীষণ অসুস্থ মনে হয়েছে। তাই আমাদের গাড়িতে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি।

শুক্রবার সকাল থেকেই স্বামী নুরুল ইসলাম দুই সন্তানকে নিয়ে টার্মিনাল-২-এ হাজির ছিলেন।

সাংবাদিকদের দেখে নুরুল ইসলাম দুই সন্তানকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, সুমি দেশে ফেরায় খুব ভালো লাগছে, কষ্টও লাগছে। ভাগ্য বদলের আশায় সৌদি আরব গেলেও এখন খালি হাতে ফিরেছে। তবে সুমি ফেরায় সরকারকে ধন্যবাদ জানাই।

তিনি বলেন, মেডিকেল ভিসার কথা বলে সুমিকে সৌদি পাঠানো হয়। যে বাড়িতে তাকে গৃহকর্মীর কাজ দেয়া হয় ওই বাড়ির মালিক তাকে ঠিকমতো খেতে দিত না। নির্যাতন করত। হাতে গরম পানি ঢেলে দিত। নির্যাতনের কথা শুনে আমি পল্টনের রূপসী বাংলা ট্রাভেলস এজেন্সির মালিক আক্তার হোসেনের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় জিডি করেছি।

সুমি পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার পাঁচপীর ইউনিয়নের বৈরাতি সেনপাড়া গ্রামের দিনমজুর রফিকুল ইসলামের বড় মেয়ে। ২০১৬ সালে আশুলিয়ার চারারবাগ গ্রামের নুরুল ইসলামের সঙ্গে বিয়ে হয়। বিয়ের পর তিনি জানতে পারেন নুরুল ইসলাম আগে দুটি বিয়ে করেছেন।

বিয়ের পর সুমি সংসার শুরু করলেও ভাগ্য বদলের লক্ষ্যে ৩০ মে সৌদি আরব পাড়ি জমান। সৌদি যাওয়ার সপ্তাহখানেক পর তার ওপর যৌন হয়রানিসহ নানা নির্যাতন চলতে থাকে।

একপর্যায়ে নির্যাতনের বর্ণনা সংবলিত তার ভিডিওটি ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। ভিডিওতে সুমি বলেন, ওরা আমারে মাইরা ফালাইব। আমারে দেশে ফিরাইয়া নিয়া যান। আমি আমার সন্তান ও পরিবারের কাছে ফিরতে চাই। আমাকে আমার পরিবারের কাছে নিয়ে যান। আর কিছুদিন থাকলে আমি মরে যাব।

পরে ব্র্যাকের সহায়তায় ২৯ অক্টোবর প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ করা হয়। পরে জেদ্দা কনস্যুলেটের হস্তক্ষেপে সুমিকে নিয়োগকর্তার বাড়ি থেকে উদ্ধার করে পুলিশ।

সুমির নিয়োগকর্তা ২২ হাজার সৌদি রিয়াল দাবি করে বসেন। পরে নাজরান শহরের শ্রম আদালতে বিষয়টি নিষ্পত্তির পর সুমিকে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের অর্থায়নে দেশে ফেরত আনা হয়।

ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল ইসলাম বলেন, সৌদি আরবে নারী কর্মীদের অধিকাংশ ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেয়া হয় না। ফলে বিপদে পড়লেও তারা কাউকে জানাতে পারেন না। অথচ শুধু যদি মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেয়া হতো, পরিস্থিতি বদলে যেত।

ফিরেছেন আরও ৮৬ কর্মী : বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ১১টায় সৌদি এয়ারলাইনসের একটি বিমানে সৌদি থেকে দেশে ফিরেছেন আরও ৮৬ বাংলাদেশি। সৌদি সরকারের ‘ন্যাশন উইদাউট ভায়োলেশন’ প্রোগ্রামের আওতায় চলমান ধরপাকড়ের মুখে পড়ে তারা দেশে ফেরেন। বুধবার রাতেও ফিরেছেন আরও ২১৫ জন। গত ২ সপ্তাহে এক হাজার ৬৪৭ জন দেশে ফিরেছেন।

কর্মীদের অভিযোগ, সৌদি আরবে বেশ কিছুদিন ধরে ধরপাকড় চলছে। এতে বাদ যাচ্ছেন না বৈধ আকামাধারীরাও। তাদের অভিযোগ, কর্মস্থল থেকে বাসায় রুমে ফেরার পথে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করছে। নিয়োগকর্তাকে ফোন করা হলেও তারা দায়িত্ব নিচ্ছেন না। আকামা থাকার পরও শ্রমিকদের ডিপোর্টেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আবার দীর্ঘদিন অবৈধভাবে থাকার কারণেও অনেককে আটক করে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দা দুলাল হোসেন জানান, ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ করে ৬ মাস আগে গিয়েছিলেন সৌদিতে। বাজার করতে যাওয়ার পথে পুলিশ তাকে ধরে এক কাপড়েই পাঠি?য়ে দেয়।

আমাকে আরেক মালিকের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল -সুমি : সুমিকে সরাসরি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদ হাসানের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আগে থেকেই হাজির ছিলেন তার বাবা রফিকুল ইসলাম ও মা মলিকা বেগম ও এ সময় পাঁচপীর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির উপস্থিত ছিলেন। হাজির হন গণমাধ্যমকর্মীরাও।

সুমিকে তার বাবা-মায়ের কাছে হস্তান্তরের সময় মুখ খোলেন সুমি। এ সময় তিনি বলেন, রূপসী বাংলা ওভারসিজের মালিক আক্তার হোসেনের প্ররোচনায় পড়েই আমি সৌদি আরবে যাই। প্রথমে রিয়াদে যাই। রিয়াদের যে মালিক ছিল, সে আমাকে রুমে বন্দি করে রাখে। খাবার দিত না। নির্যাতন করত। এরপর নজরানে আরেক মালিকের কাছে ২২ হাজার রিয়ালের বিনিময়ে আমাকে বিক্রি করে দেয়। আমি সেটা জানতাম না। সেখানেও আমার ওপর চলে নির্মম নির্যাতন।

সুমি বলেন, আমার ভিডিওটি প্রকাশের পরই আমাকে উদ্ধারে কাজ শুরু হয়। জেদ্দা কনস্যুলেটের কর্মকর্তা আবদুল হক স্যার বিভিন্নভাবে খাটাখাটনি করে উদ্ধার কাজ থেকে শুরু করে দেশে পৌঁছানো পর্যন্ত নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেছেন।

সুমি বলেন, আমি ধন্যবাদ জানাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তিনি আমার মায়ের সমতুল্য। একজন মেয়ে হিসেবে মায়ের কাছে অনেক কিছু চাইতে পারি, আমার সঙ্গে যা হয়েছে তা তো আপনারা ভিডিওতে শুনছেনই, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার একটাই দাবি, তিনি যেন আমার ভবিষ্যতটা উজ্জ্বল করে দেন।

পঞ্চগড় প্রতিনিধি জানান, হস্তান্তর পর্ব শেষে সুমীকে অ্যাম্বুলেন্সে গ্রামের বাড়ি পাঁচপীরের সেনপাড়ায় পৌঁছে দেয়া হয়। কয়েক বছর আগে সুমীকে ঢাকায় এক গার্মেন্টে নিয়ে যান মা মলিকা বেগম। এরই মধ্যে দুই বছর আগে আশুলিয়ার চারাবাগের নুরুল ইসলামের সঙ্গে বিয়েও হয় সুমীর। পরে নুরুল ইসলামই তাকে সৌদি আরব পাঠানোর উদ্যোগ নেন।


শর্টলিংকঃ