রাজশাহী ও মুক্তিযুদ্ধ (ভিডিও)


রাজশাহী ও মুক্তিযুদ্ধ

ওয়াহিদা আহমেদ:

৭ মার্স, ১৯৭১। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর বাংলাদেশের চেহারা পাল্টে যায়। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সারা বাংলাদেশে যুদ্ধের এক ধরনের প্রস্তুতি লক্ষ্য করা যায়। ছাত্র সংগঠনগুলো অবশ্য এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে শুরু হয়েছিল ছাত্র-ছাত্রীদের সশস্ত্র ট্রেনিং। ইয়াহিয়া সরকারও প্রস্তুতি নিচ্ছিল বড় ধরনের যুদ্ধের। শুরু করেছিল সারা দেশে সন্ত্রাস। বাঙালি জাতির মুক্তির স্পৃহা গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে খুব দ্রুত। ৩ মার্চ ইয়াহিয়ার বাহিনী রাজশাহীতে সান্ধ্য আইন জারি করে।

Rajshahi Muktijuddho

সরকারি কর্তৃপক্ষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ওইদিন জোর করে ছাত্রাবাস ত্যাগ করতে বাধ্য করে। সময় দেয়া হয় মাত্র ১২ ঘণ্টা। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এর প্রতিবাদ জানালে তিনি অপসারিত হন। ২৫ মার্চের কালরাতে ঢাকায় গণহত্যার সূচনা হয়। ওই রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈশ-প্রহরী আবদুর রাজ্জাককে পাকবাহিনী হত্যা করে। রাজশাহীতে মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহিদ রাজ্জাক।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতার পর ছাত্রলীগের উদ্যোগে প্রথম রাজশাহীতে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। রাজশাহী শহরের নেতৃত্বে ছিলেন, আবদুল করিম, আবদুল কুদ্দুস, জাহাঙ্গীর হোসেন, মাহফুজার রহমান, সরকার খালেক মাহবুব জামান, আবদুল মহিন, মো. শরীফ এবং মোহাম্মদ রফিকউদ্দৌলা খান। স্থানীয়ভাবে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ চলতে থাকে।

 ১৯৭১ সালের এই দিনে (১৮ ডিসেম্বর) হানাদার মুক্ত হয় রাজশাহী
১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হয় রাজশাহী

২৫ মার্চ রাতে রাজশাহী শহরে পাকবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ সম্প্রসারিত হয়। ২৫ পাঞ্জাব ব্যাটেলিয়ন রাজশাহীতে অবস্থান নেয়। মেজর আসলাম ছিলেন এর দায়িত্বে। সে রাতে পাকবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা এমএনএ নজরুল হক সরকার, শহর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ হাফিজ সাত্তার, অ্যাডভোকেট বীরেন সরকার, বঙ্গবন্ধুর বিশিষ্ট বন্ধু আবদুস সালামের দুই সন্তান সেলিমউজ্জামান, ওয়াসিম উজ্জামান, ভাই হাসানুজ্জামান (খোকা), ভগ্নিপতি সাইদুর রহমানকে হত্যা করে। এছাড়া খান সেনারা আওয়ামী লীগ নেতা ও এমপিএ আবদুল হাদির ভ্রাতা বিমা কর্মকর্তা আলতাফের ভগ্নিপতিকে হত্যা করে। তাদের হাতে অন্যান্য শ্রেণির লোকও শহিদ হয়।

রাজশাহী শহরে ইপিআর সেক্টর দফতর ছিল। সেক্টর কমান্ডার, অ্যাডজুটেন্ট, সুবেদার মেজর সকলে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি। অবশ্য মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে এ সেক্টরে বাঙালি বাড়ানো হয়। সে সঙ্গে অবাঙালি ইপিআরদের অস্ত্র দিয়ে এবং বাঙালি ইপিআরদের নিরস্ত্র অবস্থায় রাখা হয়। এ অবস্থায় বাঙালি জোয়ানদের মধ্যে অসন্তোষ লক্ষ্য করা যায়। অন্যদিকে ২৫ মার্চের পর খানসেনারা পুলিশকে অস্ত্র জমা দেবার জন্য চাপ দেয়। কিন্তু রাজশাহীর ডিআইজি দেশপ্রেমিক অফিসার মামুন মাহমুদ এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ২৬ মার্চ তাঁকে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে যায়। এরপর তাঁর খোঁজ পাওয়া যায়নি।

শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা
শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

২৭ মার্চ রাজশাহীর মীরগঞ্জে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন সুবেদার সিরাজ উদ্দিন লস্কর। এ সময় ক্যাম্পে হাজার হাজার জনতা ছিল। তিনি চারঘাট কোম্পানি হেড কোয়ার্টারে এসে পৌঁছলে বাঙালি জোয়ানরা তাঁর সঙ্গে যোগ দেয়। সারদহ পুলিশ ট্রেনিং কলেজের ক্যাডেটরাও তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এগিয়ে আসে। এ সময় সারদা ক্যাডেট কলেজের অ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন রশীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন। সুবেদার মনোহর আলীও তাঁর সঙ্গে যোগ দেন।

২৬ মার্চ সকালে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নওগাঁয় ইপিআর অস্ত্রাগারে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলিত হয়। সেদিনই রাজশাহীতে মুক্তিবাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত হয় এবং আওয়ামী লীগ নেতা বয়তুল্লাহ ও আবদুল জলিল এর নেতৃত্ব দেন। সামরিক অফিসারের মধ্যে মেজর নজমুল ও ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন অন্যতম। নওগাঁয় পাকিস্তানি এসডিও এবং ইপিআর-এর অবাঙালি কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করা হয়।

শহীদ বুধিজীবী বদ্ধভুমি স্মৃতিস্তম্ভ
শহীদ বুধিজীবী বদ্ধভুমি স্মৃতিস্তম্ভ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

ক্যাপ্টেন গিয়াস একদল সৈন্য নিয়ে বগুড়ার দিকে এবং মেজর নজমুল রাজশাহীর দিকে এগিয়ে যান। অবশ্য বগুড়ায় ছাত্র-জনতা ইতিপূর্বেই খানসেনাদের দেশীয় অস্ত্র দ্বারা পরাস্ত করে বগুড়া দখল করে নেয়। এরপর ক্যাপ্টেন গিয়াস পুনরায় রাজশাহীর দিকে অগ্রসরমান মূল দলের সঙ্গে যোগ দেন। গিয়াসের নেতৃত্বে ইপিআর, আনসার, ছাত্র, পুলিশ, জনতা মিলে প্রায় ১০০০ সৈন্য এবং সারদা হয়ে প্রায় ১০০০ সৈন্য ২ এপ্রিলের মধ্যে রাজশাহী শহরের উপকণ্ঠে সমবেত হয়। পরিকল্পনা মোতাবেক ৬ এপ্রিল সন্ধ্যা ছ’টায় মুক্তিবাহিনী প্রবল বেগে পাকসেনার ওপর আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে পাকসেনারা দিশেহারা হয়ে পড়ে।

চারঘণ্টা স্থায়ী এই যুদ্ধের শেষে পাকসেনারা প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে রাজশাহী উপশহরে সামরিক ছাউনিতে অবস্থান নেয়। মুক্তিবাহিনী রাজশাহী শহর দখল করে উপশহরস্থ পাকসেনাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিবাহিনীর হস্তগত করে। রাজশাহী শহরের জনতা বিজয় উল্লাসে ফেটে পড়ে।

১০ এপ্রিল পাকবাহিনীর একটি বড়দল স্থলপথে রাজশাহী ও কুষ্টিয়ায় পৌঁছে। পাকবাহিনী রাজশাহীর বেসামরিক অবাঙালির হাতে অস্ত্র তুলে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে আর অগ্রসর হতে পারেনি। মুক্তিবাহিনী রাজশাহী ও সারদা রোডের মোড়ে ডিফেন্স নেয়। ওইদিন পাক সেনারাদের প্রবল আক্রমণে সারদা কলেজের অধ্যাপক এবি সিদ্দিক ও বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন।

শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা
শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

১২ এপ্রিল পাকসেনারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান নেয়। তারা জোহা হল, জিন্না হলসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল আবাসিক হল দখল করে নেয়। এমনকি বিশ^বিদ্যালয় ক্লাব ও অতিথি ভবনও বাদ যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে পাকসেনারা হত্যা ও নির্যাতন চালায় আশেপাশে। ধ্বংস করে বিশ^বিদ্যালয়ের শহিদ মিনার, লুট করে সকল হল, হাবিব ব্যাংক, বিশ^বিদ্যালয় গ্রন্থগার, লাবরেটরি। ১৪ এপ্রিল থেকে পাকবাহিনীর সর্বাত্মক আক্রমণে মুক্তিবাহিনী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

মুক্তিযোদ্ধাদের মূল দলটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের দিকে সরে যেতে বাধ্য হয়। রাজশাহী শহর পাকবাহিনীর দখলে চলে যায়। ১৭ এপ্রিল পাকবাহিনী একই সঙ্গে গোদাগাড়ি ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর ব্যাপক হামলা চালায়। বিমান হামলাও অব্যাহত থাকে। ২১ এপ্রিল পাকসেনারা নবাবগঞ্জ দখল করে নেন। ক্যাপ্টেন গিয়াস তাঁর বাহিনী নিয়ে পদ্মা নদীর চরে আশ্রয় নেয়। ক্যাপ্টেন রশিদ চারঘাট এলাকা থেকে তাঁর দল নিয়ে পদ্মা নদী অতিক্রম করে ভারত সীমান্তে আশ্রয় নেন।

সূত্র: মনসুর আহমদ খান সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী’ গ্রন্থ থেকে।

 


শর্টলিংকঃ