ছায়েরা খুকু’র গল্প “রিংকু”



মানবজীবনে এমন কতগুলো ঘটনা আছে যা অবিচ্ছিন্ন। এমন কতগুলো মানুষ আছে যাদের কথা ভুলতে চাইলেও ভোলা যায়না। তারা শরতের স্নিগ্ধতার মত মানুষের মনে এসে দোলা দেয় বারবার। শীতের কুয়াশার মত মানুষের শরীরে লেপ্টে যায়। আবার বর্ষার বৃষ্টির মত কান্না হয়ে ঝরে পরে। আজ এমনই একজনের কথা তুলে ধরলাম আপনাদের মাঝে।

নামটা ছিলো তার জামিল হোসেন রিংকু। যখন তার সাথে আমি পরিচিত হই সে ছিল টগবগে তরুণ। তার উচ্ছল প্রাণবন্ত হাসি ও দেখতে সুদর্শন। চেহারাটা ছিলো মায়া ভরা। প্রথম দর্শনেই যে কেউ প্রেমে পড়বে। ১৯৯৩ সালের প্রথম মাসের দিকে এক কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকালে তার সাথে আমার দেখা । কলেজের করিডোরে হঠাৎ কে জানি আমাকে বলে উঠল,”হাই! আমাকে চিনতে পারছো?” আমি চমকে পিছনে ফিরে দেখি এই তো রিংকু! কিন্তু এই রিংকু তো আগের রিংকু নেই , ছিলো ভ্যাবলাকান্ত।

ক্লাসে স্যার ডাক দিলে ভ্যা ভ্যা করে কান্না শুরু করে দিত। আর আজ একি! আমি বললাম, “ রিংকু, তুই তো অনেক সুন্দর হয়ে গেছিস ও স্মার্ট।“ তাই বলে পাঠক ভাববেন না আমি তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। যেহেতু আগেই বলেছিলাম রিংকু ছিল চঞ্চল ও দুষ্টু মিষ্টি একটা ছেলে। সেই থেকে তার সাথে হয়ে যায় আমার সখ্যতা। রিংকুর মনে প্রেম ছিল সবসময় টুইটুম্বুর। সাগরের জলরাশির মত তার মনে প্রেম ঢেউ খেলে নিরন্তর। সে ঢেউয়ে কত মেয়ে যে ভাসতে চাইতো। রিংকু তাতেই মজা পেতো আর প্রত্যেকদিনের প্রেমকাহিনী গুলো আমাকে শুনাতো।

আমিও কেমন জানি তার প্রত্যেকটা কাহিনীই শুনতাম। ভালো লাগতো শুনতে। তখনকার তরুণরা ছিলো সিনেমা পাগল। তাই সেও ব্যতিক্রম নয়। আমিতো মেয়ে মানুষ ছিলাম তাই আমার সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা হয়ে উঠত না। মাঝে মাঝে ভিডিও ক্যাসেট এনে দেখতাম। তখনকার সালমান শাহ ছিল তার প্রিয় নায়ক। সে চলতো ও ঐ নায়কের মত। ড্রেসাপ থেকে শুরু করে মাথার চুল থেকে পায়ের তালু পর্যন্ত উনার মত করার চেষ্টা করতো। আর সিনেমা দেখে এসে আমাকে বলতো ,”দেখোনা, আমাকে তোমার কেমন লাগে? আমি তো তোমার সালমান শাহ। একটু চোখ ফিরে তাকাও।“ আমিতো হেসে কাটিকুটি হয়ে যেতাম। বলতাম,”বটে!” আমি যখন হাসতাম ওর এসব কথা শুনে, তখন তার ঐ মায়াময় চেহারাটা একদম ভ্যাবলাকান্তের মতো হয়ে যেত। বলতো আমায়, “ধ্যাৎ! তুমি একদম ও রসিক না , প্রেমিকাও না।“ তখন আমি হেসেই বলতাম, “দেখ রিংকু, আমাকে বন্ধু ভাব , প্রেমিকা ভাবিস না। নাহলে তোর এতসব আজাইরা প্রেম কাহিনী শুনানোর মানুষ পাবিনা।“

রিংকু ছিলো তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে তার বেড়ে উঠা। যেহেতু একমাত্র ছেলে তাই তার আদরের অভাব ছিলোনা। সে যা চাইতো তাই পেত। সে বলতো, “ জানো আমার একটা জায়গায় ঘাটতি তোমার চেয়ে একটু কম।“ আমি আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে বলতাম ,”কি?” সে বলতো, “আমি তোমার মত পড়ালেখায় মনযোগী নই।“ একদিন সকালবেলায় রিংকু আমাকে লিখলো চিঠি । যেই ভাবা সেই কাজ রিংকু সাহেব বলে কথা। পাঠালো তার এক চাচাত ভাইয়ের দিয়ে। আমি তো দেখে অবাক। ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম পাছে কেউ দেখে ফেলে। তাড়াতাড়ি নিলাম আর মনে মনে ভাবতে লাগলাম,” হায় আল্লাহ! এই পোলার আবার কি মতলব?”

দ্বিতীয় পর্ব

হায় আল্লাহ! এই পোলার আবার কি মতলব?” কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠিটা খুললাম । পড়েতো আমি হতভম্ব ।রিংকু প্রেমে পড়েছে , আজকে যেন আমি তার সাথে দেখা করি। সে তার প্রেম কাহিনী শুনাবে আমাকে। কিন্তু আমি দেখা করবো কি করে। আর চিঠিতে হুমকি দিয়ে সে বলেছিলো, “ না গেলে তোমার বাড়ির সামনে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবো তারপর তোমার মা তোমাকে কেলানি দিবে। হাহাহাহাহাহা !”একটা কথা বলে রাখি রিংকু আমাকে তুমি করে বলতো আর আমি ওকে তুই করে বলতাম।

তুই তোকারি্তে তার ছিলো ঘোর আপত্তি। কিন্তু আমি তো মানার পাত্রী নয় ।আচ্ছা আসা যাক তার প্রেম কাহিনীতে। কোনো রকমে মাকে সামলিয়ে ঘর থেকে বের হলাম। গেলাম নদীর পাড়ে। বিকেলে নদীর পাড়ে আমাদের ঐদিকটা বেশি সুন্দর লাগতো। নদীর পাড়ে কাশফুলের শুভ্র হাতছানি যেন এক মায়াময়। রিংকু অনেক আগে এসে বসে রইলো, তার চেহারায় যেন সদ্য প্রেমে পড়া এক যুবকের চাহনি। আমাকে দেখে দৌড়ে এসে আমার হাত ধরে উচ্ছসিত কন্ঠে বলা শুরু করলো , “জানো তোমার সতিন তোমার মত সুন্দরী , তোমার মতো দেখতে ।

তুমি অনুমতি দাও বন্ধু আমি যেন তার প্রেমে পড়ি।“ আমি বললাম, “ কেন নয়? তুই প্রেমে পরবি ,তুই হাজারবার লক্ষবার প্রেমে পরবি। তোকে তো প্রেমেই মানায়। শুরু কর তোর প্রেমিকার বায়োডাটা।“ সে শুরু করার আগে বললো, “আগে একটু বুকে হাত দিয়ে দেখোনা বিটটা ঠিকমত আছে কিনা?”তখন আমি বললাম, “ ফাজলামি করিস না তাড়াতাড়ি বল আমার যাবার সময় হয়ে যাচ্ছে।“ সে বললো, “এক্টু দাঁড়াওনা, বলছিতো, তুমি একেবারে পাষাণ। আমি বললাম,”তুই জানিসনা আমি মেয়ে মানুষ লোকে দেখলে কি ভাববে ? তাড়াতাড়ি বল।“ সে কি যেন ভেবে বলা শুরু করে দিল। তার প্রেমিকার নাম আনিলা। আনিলা নাকি দেখতে ঠিক আমার মতো। শ্যামলা বরণ চেহারাটা দেখতে নাকি অনেক সুন্দর।

দেখলে নাকি আমিও প্রেমে পড়ে যাবো। ক্লাস টেনে পড়ে। তারপর থেকে শুরু রিংকুর বাস্তব প্রেমকাহিনী। সে প্রতিদিন ক্লাসে দেরিতে আসা শুরু করলো, তার স্মার্টনেস যেন বেড়েই চললো। প্রতিদিন স্কুলের গেইটে দাঁড়িয়ে হিরোগিরি না করলে যেন তার চলেইনা। আর ক্লাসে পিছন দরজা দিয়ে ঢুকে আমার পিছনের বেঞ্চে এসে বসে শুরু করে দিত আনিলার টপিক। আমি ফিসফিসিয়ে বলতাম,” চুপ করনা ভাই পড়াতে মনোযোগ দেনা।“ কিন্তু কে শুনে কার কথা। কথাই আছেনা চোর না শুনে ধর্মের কাহিনী।

বছর খানেক পরে আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। রিংকু একদিন আমাকে বলল তার সাথে একবার যেন দেখা করি। চেহারাটাও মলিন। আমিতো দেখে অবাক আমার বন্ধুর এরকম চেহারা ।আকাশের সমস্ত মেঘ যেন তার মুখে এসে জমেছিল। আমার বুকের ভেতর যেন দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে উঠল। আমি বলেই ফেললাম, “আচ্ছা, দেখা করবো।“ তারপর দেখা করলাম সেই চিরচেনা আমার প্রিয় স্থান নদীর পাড়ে। সে আমাকে দেখে আমার হাতগুলো মুঠোতে নিয়ে হাউমাউ করে কান্না করে দিল। তার কান্না দেখে কিছু না জেনে আমিও কান্না করে দিলাম।

কিছূ জিজ্ঞাসা করতে পারছিলামনা। সে আমাকে বলতে শুরু করলো,” আনিলা বেঈমান। সে একজনে সুখী নয়। তার অনেক প্রেমিকের দরকার।“ আমি শুনেতো অবাক। এ কেমন কথা! একটা মেয়ের এতগুলো প্রেমিক কেন লাগবে? রিংকুর কিসের অভাব? আমি কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলামনা। সে বলে উঠলো,” আমি আমার প্রাণ রাখবোনা , এই বেঈমানের পৃথিবীতে আমি আর থাকবোনা।“ এখানে একটা প্লাসপয়েন্ট হলো আমি যা বলতাম সে তাই শুনতো। আমি তাকে কোনো রকমে বোঝালাম। তারপর থেকে প্রেমকে ঘৃণা করতে শুরু করলাম।

যেহেতু কলেজ জীবন শেষ তাই রিংকুর সাথে আমার যোগাযোগ একেবারে বন্ধ হয়ে গেলো। কারণ তখনকার দিনে মোবাইল ফোন তো আর ছিলোনা। এই ফাঁকে কোনো এক সময় আমার বিয়ে হয়ে গেলো শহরের এক ছেলের সাথে। আমার ছোটো ভাইয়ের থেকে মাঝে মাঝে রিংকুর খবর পেতাম। বেশ কয়েক বছর কেটে গেলো আমি সন্তান সন্ততির মা হলাম। ব্যস্ততা আমাকে পেয়ে বসলো। স্বামী ,সংসার, ঘরকন্না এইসব করতে করতে আমার দিন যায়। রিংকুর খবর ও নিইনা। কয়েক বছর আগে হঠাৎ আমার ছোটভাই আমাকে ফোন করে বলে রিংকু আর নেই।

রিংকুকে নাকি মেরে কারা জানি নদীতে ফেলে দিয়েছে। আমাদের চিরচেনা সেই নদীতে যে নদীতে সে সাঁতার কাটতো, যে নদীর ধারে রিংকুর শৈশব কৈশোর কেটেছে। আজ সেই নদীতে তার লাশ ভাসছে। আমিতো কাঁদতেও পারছিলামনা। আমার বন্ধু নাই! কিন্তু কেন মারা হলো তাকে ,কারা মারলো? আমার ভিতর উথাল পাতাল শুরু হয়ে গেছিলো। চোখের সামনে ভেসে আসতে লাগলো আগের দিনগুলোর কথা। রিংকুর মৃত্যু যেন মেনে নেয়া যায়না। এবার রহস্য ভেদ করতে শুরু করলাম কেন তার এই অকাল মৃত্যু।

আমার ছোটো ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পারলাম সব। শুনেতো আমি অবাক। রিংকু আবার প্রেমে পড়েছিলো। এবার যেমন তে্মন প্রেম নয়, পরকীয়া। পরকীয়ায় যেন তার জন্য শনি হয়ে আসলো। সে একি করলো! কেমন করে এই ফাঁদে পড়েছিলো। রিংকুকে মারার জন্য নাকি ফাঁদ তৈরি করা হয়েছিল। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করে মারা হয়েছিলো তাকে। তার বিচারের বাণী আজো নাকি নিরবে নিভৃতে কাঁদছে। তার কেসের কোনো সুরাহা হয়নি।

তার মার কান্না নাকি আজো থামেনি। সন্তানহারা বেদনায় তিনি আজ পাগলপ্রায়। জানিনা রিংকুর জীবনে কেন এমন হলো। তার কথা মনে পড়লে আজো খুব কান্না পায়। হাতড়ালে যেন তাকে পাই। সে যেন হঠাৎ করে আমাকে এসে বলে,” জানো এই মেয়েটা না আমাকে প্রেমপত্র দিয়েছে, অমুক মেয়েটা আমাকে দেখা করতে বলেছে।“ আর আমি না হেসেই হই সারা। মনে মনে শুধু বলি,” রিংকু তুই ভালো থাকিস, শান্তিতে থাকিস বন্ধু ওপারে।


শর্টলিংকঃ