অনলাইনে শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা


মো. মির্জাউল হক:

গেল কয়েক বছরে বাংলাদেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার বেড়েছে। প্রতিনিয়ত শিশুরা তথ্য প্রযুক্তির সাথে যুক্ত হচ্ছে। তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারের যেমন ভালো দিক রয়েছে আবার এর ভয়াবহ খারাপ দিকও রয়েছে। আমাদের শিশুরা নিরাপদ উপায়ে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারে সচেতন বা প্রশিক্ষিত না হয়েই ঝুঁকিপূর্ণ এ জগতে প্রবেশ করছে।

জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) ‘বাংলাদেশের শিশুদের অনলাইন নিরাপত্তা’ শীর্ষক এক জরিপে দেখা গেছে যে, দেশের ২৫% শতাংশ শিশু ১১ বছর বয়সের আগেই ডিজিটাল বিশ্বে প্রবেশ করে, যাদের মধ্যে ৩২ শতাংশ শিশু অনলাইনে হয়রানি, সহিংসতা, ভয়ভীতি ও নিগ্রহের শিকার হয় (০৬.০২.২০১৯, দৈনিক প্রথম আলো)।

জরিপটি ১২৮১ শিশুর উপর চালানো হয়। জরিপে আরো দেখা গেছে, ৯৪ শতাংশেরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অ্যাকাউন্ট আছে, ৬৩% শিশু নিজের ঘরে বসে ইন্টারনেট ব্যবহার করে, ফলে তাদের ওপর অভিভাবকদের নজরদারি কম থাকে।

জরিপ থেকে আরো জানা গেছে, ১৪ শতাংশ শিশু ইন্টারনেটে পরিচয় বন্ধুদের সঙ্গে সরাসরি দেখা করেছে, ১৭ শতাংশ শিশু অপরিচিতদের সাথে ভিডিওতে কথা বলেছে, ১১ শতাংশ শিশু তাদের ব্যক্তিগত তথ্য অনলাইনে বন্ধুদের জানিয়েছে, ১৬ শতাংশ শিশুর অ্যাকাউন্ট হ্যাকড হয়েছে এবং ৯ শতাংশ শিশু কোনো না কোনো সময় ধর্মীয় উষ্কনিমূলক বার্তা পেয়েছে। (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)

এসিডি নিয়মিতভাবে স্থানীয় ও জাতীয় সংবাদপত্র থেকে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বিষয়ক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে থাকে এবং একইসাথে এ বিষয়ে জরিপ পরিচালনা করে থাকে। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত স্থানীয় ও জাতীয় সংবাদপত্রসমূহ এবং এসিডি কর্তৃক পরিচালিত জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। নিম্নের তথ্যে শিশু নির্যাতনের ভয়াল চিত্র উঠে এসেছে।

২০১৮ সালে রাজশাহী জেলায় নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ৩০৯টি। এর মধ্যে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ১৪৭টি (৪৭.৫৭%) এবং শিশু নির্যতনের ঘটনা ঘটে ১৬২টি (৫২.৪২%)। নারী ও শিশু নির্যাতনের ধরন ছিলো- হত্যা (৬.১৮%), হত্যার চেষ্টা (৭.৭৬%), রহস্যজনক মৃত্যু (১.৬১%), ধর্ষণ (১২.২৯%), ধর্ষণের চেষ্টা (৭.৪৪%), অপহরণ (২.৯১%), আত্মহত্যা (১৪.২৩%), আত্মহত্যার চেষ্টা (৬.১৪%), নিখোঁজ (.৬৪%), যৌন হয়রানি (৭.১১%) এবং অন্যান্য (৩৩.৬৫%)।

আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত অনলাইনে শিশু ও নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থার কারণেই সব ঘটনা প্রকাশ হচ্ছে না, অনেক ঘটনা অপ্রকাশিত থেকে যাচ্ছে, অন্ধকারে থেকে যাচ্ছে। নির্যাতনের শিকার অনেক নারী ও শিশুরা বিচারের দারস্থও হচ্ছে না। কিন্তু তার ফল কিন্তু কোন না কোনভাবে প্রকাশ হচ্ছে।

অনলাইনে যৌন নির্যাতনের কারণে অনেক শিশু আত্মহত্যা করছে, আত্মহত্যার চেষ্টা করে জীবনকে বিপন্ন করে তুলছে। অনেক শিশু মানষিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে শিক্ষা জীবন থেকে ছিটকে পড়ছে। এ ধরণের খবরের শিরোনাম আমরা প্রায়ই খররের পাতায় দেখতে পাই।

২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে “এ্যাসোসিয়েশন ফর কম্যুনিটি ডেভেলপমেন্ট, রাজশাহী” এর প্রতিনিধিগণ আমার স্কুল “জাতীয় তরুণ সংঘ একাডেমি” তে স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য, শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক প্রতিনিধিদের সাথে অনলাইনে শিশু যৌন নির্যাতন ও শোষণ এবং এর প্রতিকার ও প্রতিরোধ নিয়ে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে।

মূলত এর মধ্যদিয়েই আমরা অনলাইনে শিশু যৌন নির্যাতন ও শোষণ এবং এর প্রতিকার ও প্রতিরোধ সম্পর্কে অবহিত হতে পেরেছি। আমার মনে হয় শিক্ষক হিসেবে শুধু পাঠদান করাই আমাদের একমাত্র কাজ নয়। ইন্টারনেট অপব্যবহারের এ ভয়াল থাবা থেকে আমাদের প্রিয় শিশু, আমাদের শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা শুধু জরুরিই নয় কর্তব্যও বটে।

শিশুরা কীভাবে নিরাপদে বেড়ে উঠতে পাওে সেটা নিশ্চিত করাও আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। ইতোমধ্যে আমরা শ্রেণিকক্ষে ইন্টারনেট অপব্যবহার এবং নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারের বিষয়ে সচেতনতামূলক আলোচনা শুরু করেছি। শিশুদের অনলাইনে যৌন হয়রানি থেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য বাবা-মাকে সবচেয়ে বেশি সচেতন হতে হবে এবং দায়িত্বপালন করতে হবে।

কীভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হবে সে বিষয়ে সন্তানকে সচেতন করতে হবে। পিতা-মাতার সাথে শিশুদের সম্পর্ক হবে বন্ধুত্বপূর্ণ। শিশুদের প্রতি কঠোর না হয়ে তাদের মনোভাব বুঝতে হবে। তথ্য-প্রযুক্তির জগতে প্রবেশ করানোর পূর্বে সন্তানকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হবে; শিশুকে ইন্টারনেট ব্যবহারের ঝুঁকি এবং নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার সম্পর্কে অবহিত করতে হবে।

এ সকল বিষয়ে নিয়ে আমরা অভিভাবক সভায় আলোচনা করতে পারি। আমার মনে হয়, এতে অভিভাবকরা শিশুদের নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যহারের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন। আমরা প্রতিটি স্কুলে একটি অভিযোগ বাক্স স্থাপন করতে পারি।

শিক্ষার্থীরা তাদের অভিযোগ, ঘটনা সম্পর্কে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ বাক্স এর মাধ্যমে জানাতে পারবে। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রাপ্ত অভিযোগ, ঘটনা বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ গ্রহণ করবে, শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে পারবে, প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হবে।

মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় তথ্য প্রযুক্তি সম্পর্কে পাঠদানের যথেষ্ট বিষয় থাকলেও তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার প্রতিরোধ ও প্রতিকারের বিষয়ে কোন পাঠ অন্তর্ভুক্ত রাখা হয়নি। এ বিষয়টি সরকারের নজরে আনতে শিক্ষক সমাজের দায়িত্ব পালন করা জরুরি।

আমাদের প্রিয় এবং আদরের শিশুদের ইন্টারনেটের অপব্যবহার থেকে সুরক্ষা দিতে প্রয়োজন সমন্বিত প্রচেষ্টা বা ব্যবস্থা। এ দায়িত্ব কেন্দ্রীয়ভাবে সরকারকে পালন করতে হবে। সরকারকে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে। আইনকে যুগপোযোগী করতে হবে, শিশু বান্ধব করতে হবে।

‘পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২’, ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬’, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’ এর ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের বিচার পাওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে আবার নির্যাতনকারী শিশুরও শাস্তির বিধান রাখা প্রয়োজন। আর এর জন্য আইন পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। এর এ সকল বিষয়ে শিক্ষক সমাজকে দাবি তুলতে হবে।

পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারে সম্মিলিত উদ্যোগেই আমরা আমাদের আগামী প্রজন্মকে সুরক্ষিত রাখতে পারি, শিশুদের জন্য নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারের পরিবেশ তৈরি করে দিতে পারি। আর এর মধ্য দিয়ে আমরা পাবো মেধাবী এক প্রজন্ম, যারা আমাদের এ সোনার বাংলাকে উন্নতে থেকে উন্নততর অবস্থানে পৌঁছে দিবে। এটাই হওক আমাদের সকলের প্রত্যাশা।

লেখক: প্রধান শিক্ষক, জাতীয় তরুণ সংঘ একাডেমি, রাজশাহী।


শর্টলিংকঃ