‘চির অম্লান হোক ওদের মুখের হাসি’


মুয়াজ হোসেন:

‘ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত ওদের আগ্রহ আর প্রতিভার সংমিশ্রণ দেখে মুগ্ধ হই। এবারও তার ব্যতিক্রম ছিল না। সন্ধ্যা পর্যন্ত চললো আড্ডা। সত্যিকারের ভালোবাসায় পরিপূর্ণ একটি দিন। ফেরার আগে ওদের হাসিমুখ প্রশান্তি ছড়ালো আমাদের মনে। সৃষ্টিকর্তার কাছে মনের অজান্তে প্রার্থনা করলাম ‘এই হাসিমুখগুলো যেন চিরকাল অম্লান থাকে…।’

স্টেশন বাজার সংলগ্ন বস্তিতে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করেন রাবি শিক্ষার্থীর।

১৪ ফেব্রুয়ারি। প্রেক্ষাপট, উদ্দেশ্য, ইতিহাস ইত্যাদি বিবেচনা না করে, স্রেফ ভালোবাসাকে ভালোবাসার দিন। কিন্তু এ ভালোবাসার গন্ডি কতোটুকু? এটা কী শুধু দু’জন তরুণ-তরুণী কিংবা নর-নারীর মাঝেই সীমাবদ্ধ? নাকি এর বাইরে পেরিয়ে যাবে পৃথিবীর তাবৎ মানুষ, জীবজগত কিংবা প্রাণীজগতে। সেটা নির্ভর করে আমাদের ভালোবাসা ছড়িয়ে দেওয়ার মানসিকতার ওপর।

আমরা যখন প্রিয় মানুষটিকে সাথে নিয়ে সেজেগুজে বিলাসী ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াচ্ছি, তখন আমাদের পাশেই কেউ হয়তো বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ করছে। হাত পাতছে সবার দ্বারে দ্বারে। বিশেষ দিনগুলোতে অসহায় এমন মানুষের আনাগোনা একটু বেশিই থাকে। কেউ বয়স্ক, কেউবা আবার বয়সে নিতান্তই ছোটো।

চোখ বন্ধ করে ভাবুন, আপনা- আমার ছোট ভাই-বোনের বয়সী একজন নিষ্পাপ শিশু, ঠিক কী পরিস্থিতিতে পড়লে হাত পেতে ভিক্ষা চাই? খোঁজ নিলে দেখা যাবে, তাদের অধিকাংশেরই বাবা নেই কিংবা মা নেই, কোন কোন ক্ষেত্রে মা-বাবা কেউই নেই। চোখ দুটো বন্ধ করে নিজেকে একবার ওর জায়গায় ভেবে দেখুন, কতোটা অসহায় লাগে নিজেকে।

স্টেশন বাজার ঘেঁষা বস্তিতে ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই বেড়ে ওঠা অসহায় শিশুরা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেললাইন ঘেঁষে গড়ে ওঠা বস্তিবাসীদের বেশিরভাগ পরিবারেই ওরকম একটা-দুটো বাচ্চা রয়েছে। যাদের পরিবারের লোকজন তাদের রুজির জোগান করতে গিয়ে বাচ্চাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করার চিন্তাও করতে পারেন না। সরকার কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নামকাওয়াস্তে কিছু উদ্যোগ নিলেও, তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অতোটা ফলপ্রসূ হয়না। আর হলেও সেটা হয় স্বল্পমেয়াদী।

বস্তিটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের উদ্যোগে একটি স্কুল চালু হলেও সেখানে স্থায়ী কোন শিক্ষক নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে সেখানে ক্লাস নেন। যার ফলে ওখানকার প্রায় অর্ধশত শিশুর শিক্ষা প্রায় অনিয়মিত এবং হুমকির মুখে পড়ে গেছে।

ভালোবাসা দিবসে ওদের জন্য কিছু করার সুযোগ পেলে কে-ই বা ছাড়ে! ঠিক তেমনি একটি সুযোগ এলো ভালোবাসা দিবসের বিকেলে। তাও আবার ক্যাম্পাস জীবনের শুরু থেকে নিজ পরিবারের সদস্যের মতো করে যার সঙ্গে কাটিয়েছি তিনটি বছর, সেই উর্মিলা উর্মি আপুর উদ্যোগে।

আপু, চারুকলা অনুষদের ছাত্রী। তার বিভাগ যে ভবনে, তার পাশ ঘেঁষে মেহেরচন্ডী ও বুধপাড়া এলাকা। সেখানে স্টেশন বাজার ঘেঁষে অসংখ্য সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুর দেখা মেলা হররোজ। হয়তো প্রতিনিয়ত নিজ চোখে দেখে ভালোবাসা দিবসে স্বল্প পরিসরে তার এই প্রয়াস।

সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ।

সঙ্গে পেলাম বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী নাছরিন আক্তার ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফারজানা সাঈদ শ্রাবণী। হুটহাট সিদ্ধান্তে স্বল্প পরিসরে খাতা, কলমের চেয় উত্তম কিছু আর মাথায় এলো না। সঙ্গে ওদের মনে আনন্দ জোগাতে কিছু চকলেট।

স্টেশন বাজার থেকে এসব সামগ্রী কিনে নিয়ে সেখানে পৌঁছাতে বিকেল। আশেপাশে যারা ছিল সবাইকে ডেকে-খুঁজে নেয়া হলো। পেলাম ৩৬ জনকে। বাচ্চাদের ডেকে ছোট্ট উঠোনে বসলাম সবাই৷ পরিচিতি পর্ব শেষে ওদের মাঝ থেকে কয়েকজন খুশি হয়ে কবিতা, ছড়া, গান শোনালো।

এর আগেও দু’বার প্রথম আলো বন্ধুসভার পক্ষ থেকে সেখানে গিয়েছি। প্রতিবারই ওদের আগ্রহ আর প্রতিভার সংমিশ্রণ দেখে মুগ্ধ হই। এবারও তার ব্যতিক্রম ছিল না। সন্ধ্যা পর্যন্ত চললো আড্ডা। সত্যিকারের ভালোবাসায় পরিপূর্ণ একটি দিন। ফেরার আগে ওদের হাসিমুখ প্রশান্তি ছড়ালো আমাদের মনে। সৃষ্টিকর্তার কাছে মনের অজান্তে প্রার্থনা করলাম ‘এই হাসিমুখগুলো যেন চিরকাল অম্লান থাকে…।’

হ্যাঁ, থাকবে; অবশ্যই থাকবে। আমার, আপনার, আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ওদের হাসিমুখগুলোকে স্বার্থক করে দিতে হবে। আমাদের কাছে ওদের পাওনা এটা। একটু সহানুভূতিশীল হলেই আমাদের ভালোবাসার অংশ হিসেবে ওরা চিরকাল বেঁচে থাকবে। সেই দায়িত্ব আমার, আপনার, আমাদের সকলের।

লেখক: মুয়াজ হোসেন, শিক্ষার্থী, আরবি সাহিত্য বিভাগ, চতুর্থ বর্ষ।


শর্টলিংকঃ