নিজস্ব প্রতিবেদক:
নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে ১৪ বছর ধরে আসীন মোল্লা মোহাম্মদ এমদাদুল হক। তিনি সভাপতি হওয়ার পর আর সম্মেলন হয় নি। তার কথাতেই উঠেন আর বসেন স্থানীয় এমপি ইমাজ উদ্দিন প্রামানিকও। স্থানীয় প্রশাসন মোল্লার হাতের কব্জায়। তার ছেলে মহিদুল হক বাদশার নেতৃত্বে রয়েছে কমান্ডো বাহিনী। এ বাহিনীর দখলবাজি, নির্যাতন আর অত্যাচারে এলাকায় টিকতে পারছেন খোদ দলীয় নেতাকর্মীরাও। অথচ এই মোল্লাই এক সময় বিএনপি নেতা ছিলেন। বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে নেতা হয়ে তিনি এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেছেন নিজের রাজত্ব । ক্ষমতার দাপটে ভয়ে এলাকায় কেউ কিছু বলার সাহস পান না তার বিরুদ্ধে।
এ বিষয়ে মান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান ইউনির্ভাসাল২৪নিউজকে বলেন, এমপি ইমাজ প্রামানিক বিএনপি থেকে মোল্লা এমদাদকে ভাড়া করে এনে আওয়ামী লীগের নেতা বানিয়েছেন। তার অপকর্মে দল ডুবে গেছে। অথচ আমরা তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পাই না। যে কোনো মুহূর্তে তার বাহিনী আমাকে মেরে ফেলতে পারে। এমনও হতে এটিই আমার শেষ সাক্ষাতকার। কারণ, প্রতি নিয়তই আমাকে হুমকি দেয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, স্বাধীনতার সময় ন্যাপ এবং জিয়াউর রহমানের সময় ইয়থ কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এমদাদুল হক মোল্লা। নব্বইয়ের দশকে কুশুম্বা ইউনিয়নের খোদাবক্স নামে এক ব্যক্তিকে এমদাদুল হক মোল্লাসহ কয়েকজন ধরে নিয়ে পিটিয়ে নৃসংশভাবে হত্যা করেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার সময় হত্যা মামলার আসামি হয়ে জেল খেটেছেন। এরপর তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি বিমল কুমার রায়ের স্থলাভিসিক্ত হন।
জানা গেছে, ২০০৫সালের ১১ মে মোল্লা মোহাম্মদ এমদাদুল হককে সভাপতি সরদার মোহাম্মদ জসিম উদ্দিনকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করে মান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি করা হয়। বিনা ভোটেই এ কমিটি গঠিত হয়েছিল। এরপরই উত্থান ঘটে মোল্লার।
মান্দাবাসীর মুখে একটা প্রবাদ শোনা যায়- ‘উপরে আল্লাহ, নিচে মোল্লা, মাঝে পড়ে আমরা গড়াগড়ি খাচ্ছি সমান তালে’। এমপি মুহাম্মদ ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক মান্দার জন্য সরকারী যত বরাদ্দ পেয়েছেন সবগুলোই এমদাদুল হক মোল্লাকে দিয়ে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকারি গুদামে ধান, চাল, গমসহ সবকিছু মোল্লা নিজে সরবরাহ করেন। পল্লী বিদ্যুতায়নের সংযোগ দেয়ার নামে এলাকাবাসীর কাছ থেকে চুক্তিভিত্তিক টাকা নেয়া, এমনকি বিভিন্ন সরকারি পুকুর, দীঘি লিজ দেয়ার নামে উপজেলা থেকে এমদাদুল হক মোল্লা নিজ নামে নিয়ে নামেমাত্র টাকা দিয়ে বেশি টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন জনের মধ্যে বিতরণ করেন।
এমদাদুল হক মোল্লা নিজেই উপজেলার প্রসাদপুর বাজারে ধানহাটির ৮০৭ দাগের জমি দখল করে দোকান নির্মাণ করেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ টাকায় এলাকার ছোটবেলালদহস্থ গ্রামে ৪টি, প্রসাদপুর বাজারের গোল চত্বরে (নির্মাণাধীন) ১টি, উপজেলা চত্বরের প্রধান রাস্তার দক্ষিণ পাশে ১টিসহ মোট ৮টি ২-৪ তলাবিশিষ্ট আলিশান সুদর্শন পাকা বাড়ি করেছেন। এ ছাড়া নোয়া ও হাইয়েচসহ ৪/৫টি গাড়ি রয়েছে। বাবা সভাপতি হওয়ার সুবাদে ছেলে মহিদুল হক বাদশা ক্যাডার বাহিনীর মাধ্যমে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছেন। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক চাঁদা আদায়, সরকারি জায়গা দখলসহ বালুমহাল ভোগদখল করে লাখ লাখ টাকা আয় করছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্থানীয় এমপি ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিকের ছত্রছায়ায় মান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোল্লা মোহাম্মদ এমদাদুল হক ও সাধারণ সম্পাদক সরদার মোহাম্মদ জসিম গত ১৪ ধরে কাউন্সিল হতে দেননি। এ কারণে তাঁরা এখন এলাকায় সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি তারা। নিয়োগ বাণিজ্যের হোতাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এমদাদের চাচা আব্বাস আলী মোল্লা ১৯৭১ সালে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি মুক্তিবাহিনীর হাতেই নিহত হন।
দলীয় সূত্র মতে, এমদাদ আলী মোল্লার আপন শ্যালক মকলেছুর রহমান মকে হলেন মান্দা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। শালা-দুলাভাই মিলে মান্দায় বড় দুই দলের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ করেন। আর এই সুযোগে এলাকায় এই পরিবারটি গড়ে তুলেছেন রাজত্ব। জমি দখল থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজে নিয়োগ বাণিজ্য, তদবির বাণিজ্যসহ নানা অপকর্মের হোতা মোল্লা পরিবার।
মোল্লার ছেলে মহিদুল হক বাদশার বিরুদ্ধে এক সংখ্যালঘু কিশোরীকে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ২০১৬ সালের ১৪ ডিসেম্বরের এ ঘটনাটি দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। ওই সময় সংখ্যালঘুদের মধ্যেও ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এরপর সংখ্যালঘুদের ওপর ব্যাপক তাণ্ডব চালায় মোল্লা ছেলে বাদশার ক্যাডাররা।
পরে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নির্দেশে ২৪ ঘন্টার মধ্যে আত্মসমপর্ণের নির্দেশ দেওয়া হয়। পরে ২০ ডিসেম্বর এমদাদ মোল্লা তার ছেলেকে নিয়ে থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করেন। কিন্তু এই মহিদুল হক বাদশা পরে জামিন পান।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এমদাদুল হক মোল্লার এখন মোট ৯টি বাড়ি। মান্দার যেসব স্থানে মোল্লার বাড়ি রয়েছে, এর মধ্যে প্রসাদপুরে আলিশান ‘মোল্লাবাড়ি’, বেলালদহ গ্রামে পাশাপাশি দুটি বাড়ি, একই গ্রামে রয়েছে ছেলে রাশেদের আরেকটি বিলাসবহুল বাড়ি, উপজেলা সদরের ইউএনও কার্যালয়ের সামনে সরকারি জায়গা দখল করে মোল্লা টাওয়ার, সদরেই রয়েছে আরেকটি বাড়ি, যেটিতে পল্লী বিদ্যুতের কার্যালয় করা হয়েছে। মান্দার ফেরিঘাট ব্রিজের পাশে সড়ক ও জনপথ বিভাগের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা একটি বাড়ি, প্রসাদপুর বাজারের চার মাথায় রয়েছে ছেলে মহিদুল হক বাদশার আলিশান আরেকটি বাড়ি। মোল্লার মোট ছয় ছেলে। আর চার মেয়ে। ছয় ছেলের নামেই তিনি পৃথক বাড়ি করেছেন।
তথ্য অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী ঘরানার সন্তান এমদাদুল হক মোল্লা পরবর্তীতে বিএনপি গঠনের সময় মান্দা উপজেলা ‘ইয়ুথ কমপ্লেক্সের’ নেতা ছিলেন। একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা এমদাদ মোল্লার আপন চাচা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আব্বাস আলী মোল্লাকে হত্যা করেন। ২০০৪ সালের দিকে আওয়ামী লীগে যোগদানের আগে মাত্র ৫ লাখ টাকা ঋণের দায়ে বাড়িঘর নিলামে উঠে দেউলিয়া হয়ে যান তিনি। সেসময় প্রতিবেশীর কাছে ৩ বিঘা জমি বিক্রি করে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করেন।
২০০৫ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার পর তার বিত্ত-বৈভব বাড়তে থাকে। গত ১০ বছরে মান্দায় এমদাদ মোল্লার ৭টি বিলাস বহুল প্রাসাদসম বহুতল বাড়ি, রাজশাহীতে দুটি বাড়ি, ঢাকায় ফ্ল্যাটবাড়ি, দুটি বিলাস বহুল মাইক্রোবাস ও দুটি কার কিনেছেন। এছাড়া নামে-বেনামে রাজশাহী ও মান্দর বিভিন্ন ব্যাংকে কয়েক কোটি টাকা জমিয়েছেন। বিভিন্ন স্থানে ৫০ বিঘা জমি কিনেছেন। যা তার বৈধ আয়ের সঙ্গে কোনভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
গত ১৩ অক্টোবর রাজশাহীতে হয়ে যাওয়া বিভাগীয় প্রতিনিধি সমাবেশে ক্ষোভ প্রকাশ করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবীর নানক বলেন, ‘একটি কমিটি এতোদিন ধরে থাকবে এটি মেনে নেওয়া যায় না। স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে এখানে এতোদিন কাউন্সিল করা হয়নি। তবে দ্রুত এই কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি দিতে হবে জেলা কমিটিকে। না হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আব্দুল লতিফ শেখ ইউনিভার্সাল২৪নিউজকে বলেন, ‘মোল্লার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো এলাকার মানুষের মুখে মুখে। তার ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। তার টাকা ও ক্যাডারবাহিনীর কাছে সবাই জিম্মি। এতে দলের ভাবমূর্তি তলানিতে। আমরা তার কব্জা থেকে মুক্তি চাই’।
মান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুল মান্নান বলেন, ‘স্থানীয় এমপি ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিকের ডান হাত হলেন এই মোল্লা। ইমাজের কারণে আমরা বার বার সম্মেলন করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। তাই মোল্লা ১৪ বছর ধরে রাজত্ব করে চলেছে। মান্দায় মোল্লা পরিবারের কারণে এখনো তটস্থ সাধারণ মানুষ। মোল্লার নির্দেশ ছাড়া এই উপজেলায় কোনো কাজ হয় না। তাদের পরিবারটিই হলো তদবিরবাজ।’
তিনি আরো বলেন, ‘এই মোল্লার অন্যতম সহযোগী হলো সরদার মোহাম্মদ জসিম। এই জসিম এলাকায় ‘শয়তান’ জসিম নামে পরিচিত। তার দাপটেও অতিষ্ঠ মানুষ। এ কারণে তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও দলের প্রতি অনেকটা বিরাগভাজন হয়ে আছে।’
মান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক অনুপ কুমার মোহন্ত বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সিল না হওয়ায় তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ। একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে এমদাদ মোল্লার ছেলেরা আমার বাড়িতেও হামলা করেছিল। তাদের বিষয়ে এলাকার সবাই জানে। আমাদের কিছুই বলতে হবে না।’
স্থানীয় নুরুল্লাহবাদ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রবীন নেতা প্রবোধ কুমার পোদ্দার বলেন, ‘উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এমদাদ আলী মোল্লা এলাকায় রাঘব বোয়াল। তিনি এবং তাঁর ছেলেরা এলাকায় বালুমহাল থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজের নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অপকর্মে জড়িত। এদের ভয়ে কেউ কোনো কথা বলার সাহস পায় না। এরা সেই সুযোগে কোটি কোটি টাকার সম্পদ লুটে নিয়েছে গত কয়েক বছরে। একসময় কিছুই ছিল না এদের। কিন্তু এখন মোল্লাসহ তার প্রত্যেক ছেলের রয়েছে আলাদা বাড়ি, আলাদা গাড়ীসহ অগাধ সম্পদ।’
তিনি আরো বলেন, ‘সাধারণ সম্পাদক জসিমেরও রয়েছে অগাধ সম্পদ। এরা ক্ষমতার অপব্যাবহার করে কোটি কোটি টাকার পাহাড় গড়েছেন। এদের কারণে দল এখন ন্যুব্জ। এদের হাত থেকে দ্রুতই মান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগকে বাঁচাতে হবে।’
তবে সকল অভিযোগ অস্বীকার করে এমদাদ মোল্লার ছেলে মহিদুল হক বাদশা ইউনিভার্সাল২৪নিউজকে বলেন, আমাদের পরিবার আগে থেকেই সম্পদশালী। আমাদের প্রচুর জায়গা-জমি রয়েছে। আমি নিজেও ইটের ব্যবসা করি। অনেকেই হিংসায় এসব অপপ্রচার করছে। আমরা এলাকায় প্রচুর মসজিদ-মাদ্রাসা ও মন্দির করেছি। আর আমার আব্বা জিয়াউর রহমানের সময় বিএনপি করত কি না জানি না।
তবে মান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোল্লা মোহাম্মদ এমদাদুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এখন এমপি (ইমাজউদ্দিন প্রামানিক) সাহেবের সঙ্গে আছি। পরে কথা বলব। তবে পরে কয়েক দফা ফোন করা হলেও তিনি আর সাড়া দেন নি। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সরদার জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আমি নিয়মতান্ত্রিকভাবে দুটি প্রতিষ্ঠানেরই সভাপতি। তবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আমার নিয়ন্ত্রণে আছে এটা সঠিক। কিন্তু কোনো বাণিজ্য হয়নি।’